সংবাদ কলকাতা, ৫ মার্চ: বেশ কয়েকদিন ধরে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন এনফোর্সমেন্ট এজেন্সী এবং ডিএম, এসপি-রা বৈঠক করে। এরপর আজ, মঙ্গলবার রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর কড়া বার্তা দিল কমিশন। এবার লোকসভা ভোটে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটলে তার দায় বর্তাবে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তা ডিজিপি-র ওপরে। এছাড়া ডিএম, এসপি-দেরও এই দায় নিতে হবে। সেজন্য রাজ্যকে হিংসা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যে গত ২০২১ সালের বিধানসভায় ভোট পরবর্তী হিংসা, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক ভোট লুঠের অভিযোগের তথ্যের নিরিখে সজাগ জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তাঁরা রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন বলে দাবি করেন।
রাজ্যের ডিজিপি ও মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, হিংসা রুখতে ডিএম, এসপি-দের ব্যবস্থা নিতে হবে, তারপরেও হিংসা হলে তার দায় ডিজিপি-র। তিনি বলেন, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি উৎসব ‘ভোট’। যা রাজ্যের গণতন্ত্রের উৎসব বলে পরিচিত। অর্থাৎ ভোট হল বাংলার ১৪তম পার্বণ। এই ভোটকে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও হিংসামুক্ত করায় আমাদের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলি জানিয়েছে, রাজ্যে ভয়ের পরিবেশ রয়েছে। রাজ্যের আমলারা নিরপেক্ষ নয়। প্রভাবশালীরা ভোট লুঠের চেষ্টা করে। সব রাজনৈতিক দল চায় শান্তিপূর্ণ ভোট। সিভিকদের দিয়ে ভোট না করানোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ভোটের আগে ও পরে সন্ত্রাস রুখতে ডিএম ও এসপি-দের ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্পূর্ণ জিরো টলারেন্স পরিবেশ রাখতে হবে। এরপরেও কোনও গন্ডগোল হলে দায়ী থাকবেন ডিজিপি। গন্ডগোল হলে তার দায় ডিএম, এসপি-দেরও নিতে হবে।
এই মুহূর্তে রাজ্যে মোট বুথের সংখ্যা ৮০ হাজার ৪৫৩টি। ৮৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সের ভোটাররা চাইলে বাড়ি বসে ভোট দিতে পারবেন। কিছু মহিলা পরিচালিত বুথও থাকবে রাজ্যে।
কমিশন রাজ্যকে জানিয়েছে, ভোট পর্ব নির্বিঘ্নে হওয়ার ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার। মুখ্য সচিব ও ডিজিপি-কে এই বার্তা দিয়েছে কমিশন। রাজ্যের প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষ কর্তাদের বলেন, আমাদের কাছে সব রিপোর্ট আছে। অধস্তন কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করবে জেলা প্রশাসন। ভুয়ো ভোটার রুখতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এবারের লোকসভা ভোটে রাজ্যকে যে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন, তা আজকের সাংবাদিক বৈঠকেই স্পষ্ট।
দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার এদিন সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, সম্প্রতি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। সেই সব রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর ভোটে সন্ত্রাস রুখতে রাজ্যকে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানান। কমিশন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এবারের ভোটে পেশী শক্তি এবং আর্থিক ক্ষমতার ব্যবহার যাতে না হয়, সেদিকে আমরা নজর রাখব। কোনও গন্ডগোল হলে দ্রুত কমিশনকে জানানোর জন্য app তৈরি করা হয়েছে। app-এর মাধ্যমে খবর দিলে ১০০ মিনিটের মধ্যে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচনের সময় অনুপ্রবেশ আটকাতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানোর দাবিও উঠেছে।
রাজ্যে লোকসভা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ প্রসঙ্গে চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। নাম না করলেও রাজ্যের শাসকদলকে ইঙ্গিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, একটি দল বাদে বাকিরা বাড়তি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি তুলেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে মোতায়েন করা হবে। ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায় মোতায়েন করা হবে, তা নির্ধারণ করবেন সিইও।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, গতকাল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের বিশেষ প্রতিনিধিদল। সেই দলে ছিলেন শ্রীরামপুরের সাংসদ ও আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এক দফায় ভোট এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী বাদে রাজ্য পুলিশকে দিয়ে ভোট করানোর দাবি জানিয়েছি।’ প্রকারান্তরে আজ কমিশনের মুখে সেই কথা উঠে আসে নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক বৈঠকে। এই বৈঠকে কমিশন জানায়, শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া সবাই বাড়তি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আর্জি জানিয়েছে।
এই নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট চর্চা হয়েছে, তাহলে কি শাসকদল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট চাইছে না বলেই রাজ্যের পুলিশ দিয়ে মাত্র এক দফায় ভোট করাতে চাইছে? না হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীতে আপত্তি কোথায়? তৃণমূল নেত্রী বাম জমানায় যখন শাসকদল বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন তো তিনি এভাবেই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে একাধিক দফায় ভোট দাবি করতেন। তাহলে এখন কেন উল্টো পথে হাঁটতে চাইছে তৃণমূল?