মৃন্ময় ভট্টাচার্য
মদন মুরগী হারানোর হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে ঐ নোংরা বারান্দাতেই বসে পড়ল। বিধি বাম, মনে হচ্ছে শুকনো ভাতের সাথে মুরগী মাংসের স্বপ্ন মাখিয়ে খেয়ে কোনও মতে এই বিভীষিকাময় রাতটা কাটাতে হবে।
প্রদীপকে যতই লালটুস মার্কা দেখতে হোক না কেন, ওর সাহস আছে। বলে ভোলা টর্চটা দে তো! আমি জঙ্গলে ঢুকে দেখি কবন্ধটাকে পাই কি না। বীরত্ব দেখাতে আমিও একটা হ্যারিকেন নিয়ে প্রদীপের উজ্জ্বল আলো কে অনুসরণ করতে চললাম।
"এক ছোবলেই ছবি" হওয়ার প্রবল সম্ভবনা। সেক্ষেত্রে খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের পাশে আমাদের দু'জনের নাম লেখা হবে কিনা জানা নেই। তবে নিশ্চিত যে, দুই ভূতের ভবিষ্যত আবাস হবে এই জরাজীর্ণ পলাশীর বাড়িটি। জোঁকে ধরার ভয় বহুলাংশে কম। কারণ ইতিমধ্যেই মশক বাহিনী শরীরে রক্ত যা ছিল, শোষণ করে নিয়েছে।
নজরুলের কবিতার কটা লাইন মনে পড়ে গেল।
রক্ত যা ছিল করেছে শোষণ
নিরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ
শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়
সেই হাড়ে ওঠে গান
জয় নিপীড়িত জনগণ জয়
জয় নব উত্থান
জয় জয় ভগবান।
কেন জানিনা এই মহা নিষ্ক্রমণের আগে বিপ্লবীদের মতো কবিতার লাইনগুলো আমার মনোবল সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিল।
মরতে তো একদিন হবেই। পাপী পেট কা সওয়াল। কত মানুষকে কত কি না করতে হয় শুধু পেটের জন্য। যেমন লর্ড ক্লাইভ। সেই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে এই পলাশীতে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন। ভারতীয় সেনারা এক হাঁটু বরফের মধ্যে চীন ও পাকিস্তানের গোলাগুলির সামনে বুক চিতিয়ে রাত্রিদিন দাঁড়িয়ে আছে। পি.এইচ.ডি. করা ছেলে ডোমের চাকরির দরখাস্ত করছে। আর যাদের খিদের জ্বালা অতিরিক্ত, এইট পাশ কিংবা জালি সার্টিফিকেট জোগাড় করে, জালার মতো ভুঁড়ি নিয়ে, বিবেক, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে নেতা, মন্ত্রী হয়ে দেশকে শোষণ করে চলেছে। তাঁর এবং ভবিষ্যত চোদ্দো পুরুষের পেটের জন্যই তো। তাহলে সামান্য মৃত্যু ভয়ে, আজ রাতটা মুরগির মাংস ছাড়া শুকনো ভাত খেয়ে কাটাব, তা আবার হয় নাকি!
মিনিট পনেরো খোঁজার পরই জঙ্গলের শেষ প্রান্তে একেবারে পাঁচিলের ধারে সেই মহা আকাঙ্খিত মুরগিটির সন্ধান পাওয়া গেল। সকলে একসঙ্গে আমাদের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। আমাদের প্রাণভোমরা এখনও বুকের ভিতরেই গুনগুন করছে। উড়ে যেতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে কপিলদেবের বিশ্বকাপ জয়ের থেকে আমাদের কৃতিত্ব কোনও অংশে কম নয়।
রমা'র মাংস, সরি রমাপ্রসাদের রাঁধা মুরগির মাংস ফুটছে তো ফুটছেই! এদিকে এতক্ষণ অভুক্ত থাকায় জয়ন্তকে দেখে ফুটে যেতে পারে বলে মনে হলেও ও আসলে মনে মনে রাগে টগবগ করে ফুটছে!
মাংস যখন নামল, তখন IST অনুয়ায়ী ক্যালেন্ডার তার তারিখ বদল করেছে। ভাত আগেই রেডি হয়ে ছিল। এবার পেট পুজোর পালা। আমরা সাত অভুক্ত। আর থালা যে মোটে তিনটে। রবিদা, ভোলা ও প্রদীপ তিনটে থালা অলরেডি দখলে নিয়ে নিয়েছে। বাকীরা খাবে কিসে! এই প্রায় অসম্ভব সমস্যার সমাধানের উপায় হিসাবে মনে পড়ে গেল সেই কচুপাতাগুলোর কথা। যারা এ বাড়িতে প্রবেশের সময় আমাদের সাদরে আপ্যায়ন করেছিল। ওদের গর্দান নিতে মুরগি কান্ডের ভোঁতা ছুরিটা নিয়ে আমি আর রমা আবার নিচের অন্ধকার জগতে পা রাখলাম। কচুগাছের কাছে মিরজাফর হতে বাধ্য হওয়ার জন্য আগাম ক্ষমা প্রার্থনা করে পরপর চারটে কোপে কেল্লা ফতে করলাম।
কচুপাতা দেখে সেই নির্বিবাদী অথচ মনে মনে ফুটতে থাকা জয়ন্ত ভীষণ রকম বিদ্রোহ করে বসল। সে কচুপাতায় কিছুতেই খাবে না। তার থালা চাইই চাই। থালার অধিকারীরাও তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ হাতছাড়া করতে মোটেও রাজি নয়। এতকালের গান্ধীবাদী জয়ন্ত হঠাৎ ভগত সিং-এর মতো চোখা চোখা শব্দবোমা সজোরে নিক্ষেপ করতে শুরু করল। এই নিদ্রিত, নিস্তব্ধ পলাশীর প্রান্তর মাঝে চির নির্জন ভূতুড়ে বাড়িটিতে মধ্যরাতে চরম বিশৃঙ্খলা ও কোলাহল যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনই বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে ঘটল সেই বিভীষিকাময় অবয়বের আগমন।
===========================
তারপর…….. ৫