কল্যাণ গৌতম
সোশাল মিডিয়ায়, চায়ের ঠেকে এখন রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতাটির দু’লাইন শুনিয়ে যাচ্ছেন চক্রান্ত ধরতে পারা বাঙালি, “হঠাৎ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।” সত্যিই, এরা কেউই তো বঙ্গাব্দের প্রবর্তক নন! বঙ্গাব্দের প্রবর্তক মহারাজ শশাঙ্ক। বঙ্গাব্দ দখলের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, বঙ্গাব্দের সহজ অঙ্কটি মেলাতে পারে নি আকবরপন্থী ক্যালেণ্ডারওয়ালারা। মোঘল সম্রাটের বঙ্গপ্রীতির প্রমাণও তারা দেখাতে পারে নি। সমসাময়িক প্রামাণ্য ইতিহাসে বঙ্গাব্দের টুঁ-শব্দটি নেই! একটা ক্যালেণ্ডার বানানোর পর ফের আর একটা ক্যালেণ্ডার কেন উৎরাতে গেলেন মোঘল সম্রাট, তার উত্তরও নেই। মোঘল অধিকৃত অন্য প্রদেশে ক্যালেণ্ডার নিয়ে এরকম দ্বিতীয় কোনো গল্পগাছার প্রচলন দেখি না। শশাঙ্কের কাছে দৌড়ে পরাজিত হচ্ছে দেখে আকবরকে অধিকন্তু দেখানোর গল্প এবার শোনাতে হবে আকবরপন্থীদের। তবুও পিছিয়ে পড়ছে বঙ্গাব্দের দখল নেওয়া ষড়যন্ত্রকারীর ইতিহাস বিবৃতি।
কর্ণসুবর্ণ থেকে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করেছেন তাঁর বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য! আদ্যন্ত বাঙালিয়ানায় মোড়া সেই সাম্রাজ্যের ভিত। তখন মাগধী-প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে প্রাচীন বাংলাভাষা সৃষ্টি হয়ে গেছে। বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরতও পেয়েছে বঙ্গভাষী লোকসমাজ। আর তখনই প্রয়োজন হয়েছে বাঙালির নিজস্ব ক্যালেণ্ডার – ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কবে কখন বাঙালি করবে! ‘বঙ্গাব্দ’ বাঙালি হিন্দুর নিজস্ব প্রয়োজনেই সৃষ্টি হল। এর সূচনা কোনো বিদেশি-বিধর্মী দিল্লির শাসক করে নি, যেমনটি গত একশো বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়েছে। বাঙালির কালপঞ্জিকা বাঙালিরই শুরু করা স্বাভাবিক এবং তারাই করেছে। দিল্লির বিধর্মী শাসক যদি বঙ্গাব্দের সূচনাই করবে, তাহলে অন্য রাজ্যেও তো সুযোগ ছিল, সেখানে সেইরকম আঞ্চলিক ক্যালেণ্ডার কেন শুরু করল না তারা? বেছে বেছে বাঙ্গলাকেই তারা কৃপা করল কেন? সোজা অঙ্কের হিসেব, বঙ্গাব্দ যদি ১৪৩২ হয়, তবে মোঘল সম্রাটেরা কি আজ থেকে ১৪৩২ বছর আগেকার শাসক? এই মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা সেই ইতিহাসবিদেরই শোভা পায়, যাদের হিন্দু বিরোধিতা মজ্জাগত ব্যাপার। অতএব, মিথ্যাতত্ত্ব বাতিল করে বাংলা নববর্ষের শুরুতে শ্লোগান উঠুক, “জয় বঙ্গ জয় শশাঙ্ক।” বাঙালির হৃদয়ে শিবাজি যেমন বিরাজিত আছেন, থাকবেন শশাঙ্ক এবং মহারাজ প্রতাপাদিত্যও।
সত্যিকারের বাঙালিকে, বীর বাঙালিকে ভুলে যাওয়া, বা ভুলতে চাওয়া বাঙালির অভ্যাস। তেমনই বীর বাঙালি ছিলেন শশাঙ্ক; ছিলেন সার্বভৌম এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক, অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম তিনি। হিন্দু বীর বলেই কী! আজকের মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা-য় বসে বিস্তৃত গৌড়রাজ্য শাসন করতেন শশাঙ্ক। তাঁর বীরত্ব ও বিক্রম নিয়ে হিন্দু বাঙালি আবারও সামনে এগোতে চায়। তবে বাঁধা একটাই। যে বাঁধা ভগবান রামচন্দ্রকেও দিয়ে থাকে অমেরুদণ্ডী বাঙালি। মেরুদণ্ডী বাঙালির তাই দাবী, মুর্শিদাবাদ জেলার নাম হোক ‘কর্ণসুবর্ণ’। তাহলে শশাঙ্কের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।
স্বতন্ত্র, সার্বভৌম বাঙালি-হিন্দু সাম্রাজ্যের অধীশ্বর গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। প্রায় সোওয়া চৌদ্দশো বছর আগে ভারতবর্ষের পূর্বাংশে শুরু হয়েছিল তাঁর বিজয়যাত্রা। বর্তমান মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে (বর্তমান বহরমপুরের কাছে রাঙ্গামাটিতে) তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি গুপ্ত বংশীয় এক নরপতি, ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ বা ‘নরেন্দ্রাদিত্য’ তাঁর প্রকৃত নাম। বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’-এ ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ নামটি পাওয়া যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্রে ‘শ্রীনরেন্দ্র বিনত’ — এমন কথা পাওয়া গেছে। হতে পারে তিনি মগধের গুপ্তবংশজাত মহাসেনগুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র। কারও মতে এই মহাসেনগুপ্ত ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কনিষ্ঠপুত্র গোবিন্দগুপ্তের বংশ-শাখা। গুপ্তসম্রাটগণ যেখানে ভাগবত-মতাবলম্বী বৈষ্ণব, শশাঙ্ক ছিলেন শৈবপন্থী সম্রাট। শশাঙ্কের আমলের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার একপিঠে রয়েছে নন্দীর পৃষ্ঠে উপবিষ্ট মহাদেবের মূর্তি, অন্য পৃষ্ঠে দেখা যায় কমলাত্মিকা অর্থাৎ পদ্মাসনে সমাসীনা লক্ষ্মীমূর্তি।
শশাঙ্ক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পুষ্যভূতি বংশের সম্রাট হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক ছিলেন। চীনদেশীয় শ্রমণ ও পর্যটক হিউয়েন সাং-এর ‘সি-ইউ-কি’ গ্রন্থে এবং হর্ষবর্ধনের অনুগামী বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’-এ যে সমস্ত বিবরণ আছে, তা শশাঙ্ক সম্পর্কে সঠিক নাও হতে পারে। বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের সামীপ্যে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি আপন ধর্মাবলম্বী রাজার শত্রুরাজা সম্পর্কে সুবিচার নাও করতে পারেন এবং সেটাই হয়েছে। শশাঙ্ক সম্পর্কে প্রচার আছে, তিনি সন্ধির নিমিত্তে আগত নিরস্ত্র রাজা রাজ্যবর্ধন (হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠভ্রাতা)-কে হত্যা করেছিলেন এবং রাজ্যবর্ধনের ভগ্নীপতি মৌখরীরাজ গ্রহবর্মাকে হত্যার নিমিত্তে মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হন এবং ভগিনী রাজ্যশ্রীকে জঙ্গলে কারারুদ্ধ করার আদেশ দেন। শশাঙ্ক সম্পর্কে এও প্রচলিত আছে, তিনি নাকি বহু বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন! কিন্তু শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের কাছেই বহু বৌদ্ধ মন্দির অক্ষত ছিল, এটা সম্ভব হল কীভাবে? তথ্য এই, তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি শিক্ষার প্রসারে রাজ-সহযোগিতা বজায় রেখেছিলেন।
জানা যায়, বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের শাসনকালের পূর্বাপর উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণেরা অসম্মনিত হলে, সরযূ তীরবর্তী অঞ্চলের গ্রহবিপ্রদের গৌড় অভিমুখী অভিবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন শশাঙ্ক। তিনি সুশাসক ছিলেন এমন পরিচয় যথেষ্ট পাওয়া যায়। প্রজাবর্গকে জলকষ্ট থেকে রেহাই দিতে মেদিনীপুরের কাছে দাঁতনে দেড়শো একর জমির উপর ‘শরশঙ্ক’ নামক বৃহৎ দিঘী খনন করিয়েছিলেন। তাঁর আমলে গৌড় সাম্রাজ্য কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করে।
জানা যায়, রাজা শশাঙ্ক কালগণনার ক্ষেত্রে সূর্য সিদ্ধান্ত পদ্ধতি ‘বঙ্গাব্দ’ চালু করেন। ৫৯২/৫৯৩ খ্রীস্টাব্দে এই সৌরভিত্তিক কালগণনার শুরু। সম্ভবত এই বঙ্গাব্দ চালুর প্রথম বৈশাখের প্রথম দিনে তাঁর রাজ্যাভিষেক। আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীস্টাব্দ ছিল তাঁর শাসনকাল। তাঁর রাজকার্যের প্রচলিত ভাষা ছিল প্রাচীন বাংলা এবং রাজধর্ম ছিল হিন্দু। তিনিই প্রথম অপরাজিত এবং বিস্তৃত বঙ্গের একচ্ছত্র শাসক। ছিলেন ধর্মসংরক্ষক এবং পরধর্মসহিষ্ণু। বাঙালি কৃতবিদ্যদের মধ্যে তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, কিন্তু কালের গর্ভে তাঁর সমস্ত ইতিহাস হারিয়ে গেছে, যা আছে তাও পক্ষপাতদুষ্ট বলে ঐতিহাসিকদের মতামত। প্রকৃত ইতিহাসের অনুসন্ধান জরুরি।
ছবি: শীর্ষ