মিলন খামারিয়া, কলকাতা, ৩০ জুন: গতকাল কলকাতার বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠে অনুষ্ঠিত হল ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ’-এর ৩৮ তম বার্ষিক সাধারণ সভা। প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে এই সভার শুভ সূচনা হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কার ভারতীর অখিল ভারতীয় মন্ত্রী সঞ্জয় চৌধুরী, আর.এস.এস.-এর দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত প্রচারক প্রশান্ত ভট্ট, আর.এস.এস.-এর পূর্বক্ষেত্র সঙ্ঘচালক ড. জয়ন্ত রায়চৌধুরী, EZCC -এর অধিকর্তা আশিস গিরি, আর.এস.এস.-এর দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের প্রচার প্রমুখ বিপ্লব রায়, সংস্কার ভারতীর অখিল ভারতীয় কার্য কারিণী সদস্যা নীলাঞ্জনা রায়, সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ-এর কার্যকরী সভাপতি ও সভাপতি যথাক্রমে সুভাষ ভট্টাচার্য ও ড. স্বরূপ প্রসাদ ঘোষ ও আরও অনেকে।
এই সভায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাব নেওয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম বঙ্গের লোকনাট্যের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ যাত্রাশিল্প সম্পর্কে; যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকশিক্ষা, সামাজিক বার্তা ও সাধারণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে মানবহৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত।
এক সময় গ্রাম বাংলার মেলায়, পার্বণে, উৎসবে – যাত্রা ছিল মানুষের প্রধান আকর্ষণ। ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে কিংবা সামাজিক, ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাবলী আধারিত কাহিনী নিয়ে যাত্রা মঞ্চস্থ হতো গ্রাম বাংলার বিনোদনের প্রধান আসর যাত্রানুষ্ঠানে।
তবে যাত্রা কেবল বিনোদন নয়, এটির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ তথা অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা, তাদের সংগ্রামের কথা প্রতিবিম্বিত হতো,যা সকল স্তরের মানুষের কাছে বোধগম্য হতো সহজেই। তাই গ্রাম বাংলার কিয়দংশ মানুষের কাছে এখনো যাত্রা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, যার মাধ্যমে তারা সহজেই সমাজ সচেতনতা, সাংস্কৃতিক আদান- প্রদানের মতো শৈল্পিক বিনোদন খুঁজে পায়।
এই যাত্রা শিল্প সম্পর্কে সংস্কার ভারতীর কার্যকরী সভাপতি সুভাষ ভট্টাচার্য বলেন, দুঃখের বিষয় – কালের গহ্বরে আধুনিকতার দংশনে, দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে এককালের বাঙালির বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ এই যাত্রাপালা। কারণ হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্য অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির এই লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য, এই যাত্রাপালা আজ জৌলুসহীন।
সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক তিলক সেনগুপ্ত বলেন,আগের মতো গ্রাম বাংলায় এখন আর সন্ধ্যা নামলেই মেলা থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না- ‘হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার।’ যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে তেমন শিহরণ জাগে না। বর্তমান সমাজে ডিজিটালাইজেসনের প্রভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া আজ শহরে -গ্রামে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মনোরঞ্জনের সমস্ত উপকরণ। ফলে, জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক ভাবেই কমছে বাংলার লোককলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যাত্রা পালার।
এই পরিস্থিতিতে একবার হলেও আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্কার মাধ্যম যাত্রা শিল্পের মতো এক গৌরবময় ঐতিহ্যকে, কি ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়?
যদিও বাংলার কৃষ্টি আর এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা আজও করে যাচ্ছেন যাত্রা শিল্পীরা।
নীলাঞ্জনা রায় বলেন,এক সময়ের স্বমহিমায় গড়ে ওঠা শিল্প ঐতিহ্য আজ ধুঁকছে, অভাব অনটনে পরিবার নিয়ে দুরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন যাত্রা শিল্পীরা। তাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির – ঐতিহ্যের ধারক এই যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আধুনিকীকরণের পথ ধরেই সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া কর্তব্য। বিশেষত, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের যাত্রাপালা সম্পর্কে উৎসাহিত করা এবং কীভাবে এই শিল্পকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব, যার মাধ্যমে এই ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য ধারাকে টিকিয়ে রাখা যায়, তার একটি বিশেষ সমীক্ষার আশু প্রয়োজন মনে করছে সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ।
আশিস গিরি বলেন, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু কিছু শিল্পকে কেন্দ্রীয় সরকারকে মর্যাদা দিতে হবে, তার মধ্যে অন্যতম হল কীর্তন। কীর্তনের মানে হল কীর্তির গুণগান করা। কীর্তনের সৃষ্টি হাজার হাজার বছর আগে। নারদ ব্রহ্মা, বিষ্ণুর গুণগান করতেন যা ব’লে তাকেই বলা হতো কীর্তন। আর মন্দিরে ভগবানের সামনে যা করা হয় তা হল প্রবন্ধ সঙ্গীত। সেই কীর্তনকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।
২০২৫ সাল কালজয়ী ‘বন্দেমাতরম সঙ্গীত’ রচনার সার্ধশতবর্ষ। এই সঙ্গীত সারা ভারতের বিপ্লবীদের আলোড়িত করেছিল। এই সঙ্গীতের তাৎপর্য প্রচারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টায় এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে সারা বছর বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি বিশুদ্ধ হাস্যরস সৃষ্টি করা নিয়েও সভায় আলোচনা করা হয়।