— কল্যাণ চক্রবর্তী
13 April, 2020: ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতা থেকে একটি অংশ, “হঠাৎ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।” কারণ এরা কেউই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক নন। প্রবর্তক মহারাজ শশাঙ্ক। বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল নড়েচড়ে বসলো। তখন করোনা পরিস্থিতি। মহামারীর মাঝে এ কী বেসুরো কথা! সে বছর অবশ্য সরাসরি মাঠে নেমে মহারাজ শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের সূচনাকারী রূপে প্রতিষ্ঠা করা না গেলেও, অনলাইনে, ঘরোয়া নানান বৈঠকে, নববর্ষের নানান আলোচনায় শশাঙ্কের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরলাম। সেই সঙ্গে সদ্য তরুণ, কলকাতা গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র, শীর্ষ আচার্যকে বললাম, মহারাজ শশাঙ্ককে নিয়ে কিছু ছবি আঁকো, মূর্তি গড়ার পরিকল্পনা করো। এই রকম ছবি আঁকার জন্যই আরও অনেক শিল্পীকে নিয়ে ‘হিন্দু শিল্প সুষমা’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়ে গেল শীর্ষ আচার্যের সংহত প্রচেষ্টায় ও নেতৃত্বে। শীর্ষ আমাকে বললো, শশাঙ্কের বিস্তারিত ঐতিহাসিক পরিচয় জানাও, যাতে আমার মানসচক্ষে তাঁকে অনবরত দেখতে পাই।
যেই বলা সেই কাজ, ২০২০ সালের নববর্ষ থেকেই টেলিফোনে, অনলাইনে, অফলাইনে মাঝেমাঝেই শীর্ষের সঙ্গে শশাঙ্ক বিষয়ক নিত্য আলোচনা হতো। লেখা পাঠাতাম, ইতিহাসের পাতা মেলে ধরতাম। শীর্ষকে বললাম, অন্তরের অনুভূতিতে তোমার আপন ইতিহাস চেতনার সত্য সংকল্পে যে ছবি বিমূর্ত ধারণা থেকে উৎসারিত হয়ে তোমার তুলিতে, তোমার ছেনিতে অনুপম সৌকর্যে মূর্ত হয়ে উঠবে, তিনিই হবেন প্রায় ১৪০০ বছর আগেকার বিস্মৃতপ্রায় সম্রাট শশাঙ্কের এক একটি প্রাঞ্জল পট, বীর হিন্দু-বাঙালির চিরকালের সার্বভৌম রাজা। তুলে দিলাম শ্লোগান-ধর্মী মন্ত্র: “জয় বঙ্গ জয় শশাঙ্ক।” শীর্ষের অনুধ্যান এবং ধ্যান তখন থেকেই শুরু হল।
শশাঙ্ক অঙ্কনে শীর্ষের প্রথম প্রচেষ্টা পেনের কালির মিডিয়ামে সাদা-কালোয় ‘গৌড় সম্রাট শশাঙ্ক’ শিরোনামে একটি ছবি। ছবির চারপাশে জুড়ে আছে শশাঙ্কের প্রচলিত মুদ্রা এবং উৎকীর্ণ লিপিমালা। আর বঙ্গাব্দের একটি ধারণা। ছবিটি 15 May, 2020-তে শীর্ষ নিজেই ফেসবুকে প্রকাশ করে এবং মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। ছবিটি ফেসবুকের ‘দেশের মাটি (ধর্ম ও বিজ্ঞান)’ গ্রুপেও সে পোস্ট করে।
পরের বছর (15 April, 2021) শীর্ষ আঁকলো শশাঙ্কের কালজয়ী এক ছবি, যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শৈব-শশাঙ্কের সিংহাসনের পিছনে নৃত্যরত শিবের চিত্রপট। শিব প্রলয়কারী, ধর্মবিপ্লব ছাড়া ধর্মরক্ষা করা কী সম্ভব — ছবিটি দেখে প্রশ্ন উঠবে হিন্দু বাঙালির মনে। সিংহ-চিহ্নিত আসনে অর্ধ-উপবিষ্ট অর্ধ-উদ্যতপ্রায় হিন্দু রাজা শশাঙ্কের চিত্র; দক্ষিণ হস্তে তর্জনী নির্দেশ করে তিনি যেন বলছেন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’। দক্ষিণ পা ঈষৎ এগিয়ে রয়েছে এক চরণবেদীর উপর। হয়তোবা সুকোমল চরণবেদী থেকে কণ্টকাকীর্ণ ভূমিতে এই সৈনিক-রাজা আপনার পদস্থাপন করে যেকোনো মুহূর্তে বলবেন, “চরৈবেতি চরৈবেতি”। মাটিতে রাখা বাম-পা যেন সেই নির্দেশেরই অপেক্ষায়! বা-দিকে একটি ফলকে বঙ্গাব্দের তথ্যসমূহ যেন হিন্দু বাঙালিকে প্রাণিত করে চলপছে। হিন্দু রাজা শশাঙ্কের একটি নির্ভূল চিত্র এইভাবে হিন্দু বাঙালির মনে স্থান করে নেয়। ১৬ ই এপ্রিল, ২০২১-এ ‘Baarta Today’ নিউজ পোর্টালে কল্যাণ চক্রবর্তীর লেখা একটি প্রবন্ধের অপরিহার্য অঙ্গরূপে স্থান পেয়েছে তা। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘জয় বঙ্গ জয় শশাঙ্ক।’ ছবিটির সঙ্গে কল্যাণ চক্রবর্তী রচিত একটি কবিতাও স্থান পায়। পরের বছর (২০২২) থেকে শশাঙ্ক-স্মরণ ও নববর্ষ বরণ সংক্রান্ত নানান সংগঠনের নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতাটি পঠিত হতে শুরু করে। শীর্ষের এই ছবিটি শশাঙ্ক সম্পর্কিত ‘উইকিপিডিয়া’-তে স্থান পেয়েছে। এটাই বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত শশাঙ্কের ছবি।
এরপর 14 April, 2023: পূর্ববর্তী আলোচনার সূত ধরে শীর্ষ প্রথম গড়লেন শশাঙ্কের একটি আবক্ষ মূর্তি। শিরোনাম: ‘জয় বঙ্গ জয় শশাঙ্ক।’ ১৪৩০-এর বর্ষবরণের প্রাক্কালে কল্যাণ চক্রবর্তী রচিত কবিতাটি সেদিন আবৃত্তি করেছিলেন সংস্কার ভারতীর লিপিকা দিদি। উপলক্ষ ছিল ‘বাংলার আলপনা’ বিষয়ে দেওয়ালপঞ্জি রচনা এবং তার উদ্বোধন। আয়োজক ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ন্যাস এবং সংস্কার ভারতী। দেওয়ালপঞ্জিতে আলপনা যারা এঁকেছিলেন তারা সম্মানিত হলেন মঞ্চে। শীর্ষ আচার্য সেদিন মঞ্চে গড়লেন রাজা শশাঙ্কের মূর্তি। স্থান: EZCC প্রেক্ষাগৃহ, সল্টলেক, কলকাতা। মূর্তিটি নির্মিতির শেষ পর্বে শিল্পকার্যে নিয়োজিত শিল্পীসহ একটি ছবি তুলিয়ে নিজেই সেদিন পাঠান শীর্ষ। সেই ছবিটিকে কেন্দ্র করে ড. কল্যাণ চক্রবর্তী ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৩-এ Kolkata News Today পোর্টালে একটি নিবন্ধ লেখেন। শিরোনাম: ইতিহাসের এক অবহেলিত চরিত্র গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। লেখকের কলমে ফুটে ওঠে, “সত্যিকারের বাঙালিকে, বীর বাঙালিকে ভুলে যাওয়া, বা ভুলতে চাওয়া বাঙালির চিরকালের অভ্যাস। এমনই এক বীর বাঙালি ছিলেন শশাঙ্ক; ছিলেন সার্বভৌম এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ভারতের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম।”
এরপর থেকে মহারাজ শশাঙ্কের অবয়ব কেমন হবে, ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য রচনার দুনিয়ায় তা স্পষ্ট হয়ে যায়। শীর্ষ আচার্যের ছবিই মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করে।
13 April, 2024: এদিন শীর্ষ তাঁর ফেসবুক পেজে ‘বঙ্গাব্দের প্রণেতা গৌড়াধিপতি মহারাজা শশাঙ্ক’ শিরোনামে নিজের আঁকা একটি ছবি পোস্ট করেন। পরবর্তীকালে ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ছবিতে রাজা শশাঙ্কের হাতে খড়গ, পিছনে বাংলার দশভূজ নর্তেশ্বর শিব অঙ্কিত রয়েছে দেখা যায়। ছবির সঙ্গে “শশাঙ্ক ছাড়া বঙ্গাব্দের কৃতিত্ব আর কোনো সম্রাটকে দেওয়া যায় না” — এই শিরোনামে কল্যাণ চক্রবর্তীর প্রবন্ধও ভাইরাল হয়। সেদিন অনেকেই নিজের ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি-তে শশাঙ্কের এই ছবিটি তুলে ধরেন। এই প্রবণতা এখনও আছে। ২০২৪ সালে শীর্ষ আচার্যকে শশাঙ্ক সম্পর্কিত দু’টি সুদৃশ্য সিল বা শিলমোহর স্টাইলে ছবি আঁকতে দেখা যায়। ১১ই এপ্রিলে প্রকাশিত শিলমোহরের চারপাশে একটি অনবদ্য গেরুয়া আভা। আরেকটি শিলমোহর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩ই এপ্রিল। দু’টি শিলমোহরেই শশাঙ্ক তাঁর দক্ষিণ বাহু তুলে দক্ষিণ স্কন্ধে ধারণ করে আছেন একটি যুদ্ধাস্ত্র। এই দু’টি ছবি দিয়ে অনেক হিন্দুত্ববাদী মানুষ নিজের ডি.পি. করে থাকেন।
8 April, 2025: এদিন মহারাজা শশাঙ্কের প্রথম এবং একমাত্র পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপিত হয় শীর্ষ আচার্য নির্মিত একটি ভাস্কর্য দিয়ে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিস, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং সংস্কার ভারতী (পশ্চিমবঙ্গ) দ্বারা স্থায়ী ভাবে স্থাপিত হয়েছে এই মূর্তি। উপলক্ষ ছিল ‘ভারতীয় সংস্কৃতি ন্যাস’ আয়োজিত এবং ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ’ নিবেদিত ‘নববর্ষ আবাহন উৎসব’ এবং ‘সাংস্কৃতিক দেওয়ালপঞ্জী লোকার্পণ (বঙ্গাব্দ ১৪৩২)’ অনুষ্ঠান। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভাষা ভবন’ হলে এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
9 April, 2025: এদিন ‘Baarta Today’ নিউজ পোর্টালে ‘বঙ্গাব্দের পূর্ণ কৃতিত্ব শশাঙ্কেরই প্রাপ্য’ শিরোনামে শশাঙ্ক বিষয়ক একটি প্রবন্ধের সঙ্গে অনবদ্য ছবি পরিবেশিত হয় শীর্ষ আচার্যের আঁকা। উজ্জ্বল রঙে সুশোভিত এই ছবি। যেন রাজা শশাঙ্কের সিংহাসনে আসীন হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কথা বলে চলেছে, একটি পূর্ণাবয়ব রাজসভার মাঝে বীরদর্পে সামাজিক মতিনিয়ে চলা রাজা শশাঙ্ক। April, 10, 2025: ‘সংবাদ Kolkata’ পোর্টালে প্রকাশিত হয় “শশাঙ্ককে ব্রাত্য করে রাখা হয় বঙ্গাব্দের কৃতিত্ব দেওয়া হবে না বলে” — এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ। শশাঙ্ককে নিয়ে শীর্ষ আচার্যের চিত্র-গবেষণা চলছেই। আগামীদিনে ইতিহাস-আশ্রিত শশাঙ্ক ও সমকালীন ভারতবর্ষ বিষয়ক একটি ছবির অ্যালবাম স্বহস্তে গড়ে তুলবেন তিনি।
next post