29 C
Kolkata
August 2, 2025
Featured

আমি তোমারি মাটির কন্যা

“আমি তোমারি মাটির কন্যা জননী বসুন্ধরা –
তবে আমার মানব জন্ম কেন বঞ্চিত করা।”

    বারে বারে যুগে যুগে শুধু বঞ্চিত। যোগ্যতা থাকা সত্বেও কেন এই উপহার ?? 
         বৈদিক যুগে ভারতবর্ষের মহিলাদের ব্রহ্মবাদিনী বলা হতো। কারণ তাঁরা ব্রহ্মবিদ্যা চর্চা করতেন। কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়-  বিশ্ববারা, ঘোষা, অপলা, গার্গী , লোপামুদ্রা । ব্রহ্মজ্ঞানের তর্কসভায় ব্রহ্মবাদিনী গার্গীকে কিছুতেই পরাজিত করা যাচ্ছিল না। তাই ব্রহ্মবাদী পুরুষ সমাজ তর্কসভায় হুমকি দিয়েছিল যে, চুপ না করলে মুন্ড খসে যাবে। 
     আবার বিদুষী জ্যোতির্বিদ খনার গল্পও সবার জানা। খনার বচন : "দূরমন্ডল নিকটজল/ নিকট মন্ডল রসাতল" । অর্থাৎ চাঁদের চারিদিকে যদি একটু দূরে প্রভামণ্ডল তৈরী হয় তবে শীঘ্রই বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা।আর যদি চাঁদের চারিদিকে প্রভামন্ডল একদম গায়ে গায়ে হয় তবে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পৃথিবী রসাতলে যাবে।  এই রকম একজন গুণী  নারী শ্বশুরের গণনার ভুল ধরেছিল তাই তার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ছলে বলে কৌশলে মেয়েদের যোগ্যতা থাকা সত্বেও ক্ষমতা বা পেশীশক্তির দ্বারা পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তথাপি  ভারতবর্ষের বুকে বেশ কিছু মহিয়সী নারীদের কথা জানা যায়  যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন, আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা, সমাজসেবা, শিল্প সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ সংস্কারক ইত্যাদির ক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।    কিছু উদাহরণ : 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে ভারতীয় সমাজ। বেশ কয়েকজন হিন্দু নারীদের নাম উল্লেখ করা যায় যাঁরা নারী শিক্ষা ও জাগরণের মাধ্যমে সমাজের সকল বাধা দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন – রাসসুন্দরী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ভুবনমোহিনী দেবী, সরোজিনী নাইডু ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মহাশয় ও কেশব চন্দ্র সেনের নাম অবিস্মরণীয়। স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন ভারতে নারী শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন। শিক্ষার আলোকে আলোকিত বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন যে, শিক্ষাই নারীকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। সমাজে পুরুষের সমকক্ষ হতে গেলে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। তাঁর মতে নারীরা সমাজের অর্ধেক অঙ্গ। কবি নজরুলের ভাষায় ” অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”। মধ্যযুগের মহিলা কবি চন্দ্রাবতী দেবী, তিনি মহিলা কেন্দ্রিক একটি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। প্রথম বাঙালি নাট্যকার হিসেবে কামিনী সুন্দরী দেবীর নাম উল্লেখ্য। এছাড়াও প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা প্রায় সর্বজনবিদিত। চন্দ্রমুখী বসু ছিলেন প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট। দূর্বা ব্যানার্জী প্রথম মহিলা পাইলট। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রথম বাঙালি সভাপতি সরোজিনী নাইডু (১৯২৫) র নাম জানা যায়।

  মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলার নৃত্যের একটি বর্ণনায় রয়েছে - " মুখে মন্দ মন্দ হাসি/ ক্ষেনে উঠি ক্ষেনে বসি"। অর্থাৎ  নৃত্যের সময় বেহুলার মুখে মধুর লাস্যময় মৃদু কোমল হাসি ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে হাসি মুখে উঠে বসে নৃত্য করছে। বাংলা সাহিত্যে এই মৃদু কোমল গম্ভীর মধুর ছন্দে বা মন্দাক্রান্তা ছন্দে বঙ্গ রমনীরা বহু  সাহিত্য চর্চা করে গেছে। আমরা জানি, মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্য মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচনা করেছিলেন। সেই সূত্র ধরে কবিগুরু রচনা করলেন " ধীরে ধীরে ধীরে বও/ ওগো উথল হওয়া। 

সেই বৈদিক যুগ থেকেই রমনীদের সাহিত্য চর্চার ভিত্তি স্থাপন হয়ে গেছে। তারপর বিভিন্ন সময়ে জোয়ার ভাটার গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই আলোচনায় ঠাকুর পরিবারের অবদান উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, ঠাকুর পরিবারের মহিলারা অন্ত:পুরে বৈষ্ণবীদের কাছে শিক্ষালাভ করতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের দিদিমা শিক্ষিত ছিলেন বলে জানা যায়। রবীন্দ্র গান ঠাকুরের বড় দিদি স্বর্ণকুমারীদেবী উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। লেখিকা রূপে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। গুরুদেবের ভ্রাতুষ্পুত্রী শোভনসুন্দরী ” The Orient Pearls” নামে একটি বই লেখেন ১৯১৫ সালে। বইটি বিলেত থেকে প্রকাশিত হয়। কবির সেজদাদার পুত্র – কন্যারা ‘ পূণ্য ‘ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন এবং সম্পাদিকা ছিলেন শোভনসুন্দরী দেবী। সাহিত্য চর্চায় পূর্ণশশী দেবীর কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন বাংলার অদূরে( পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ বা বিহারে), যেখানে বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। সেখানে তাঁর বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা। বেশ কয়েকটি গল্প লেখেন। লেখার জন্য তিনি কুন্তলীন পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। এই কুন্তলীন পুরষ্কার সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক – স্বদেশী গন্ধতেল কুন্তলীন প্রস্তুতকারী হেমেন্দ্রমোহন বসু তাঁর দ্রব্য প্রচারের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিতে বিজ্ঞাপনবাহী গল্প রচনার জন্য ১৯০৩ সাল থেকে ভালো গল্পের ভিত্তিতে পুরষ্কার দেওয়া শুরু করেন। এটি এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সেইসময় পুরষ্কারটি অন্ত:পুরবাসিনী মহিলারা সবথেকে বেশী সংখ্যক পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। যা দেখে অন্যান্য মহিলারা সাহিত্য অঙ্গনে পা রাখতে উৎসাহী হয়েছিলেন। দেখা যায় পুরুষ লেখকরা মহিলাদের ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। যেমন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শ্রীমতি রাধারানী দেবী ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি রমনীদের আরেকটি সংস্কৃতি চর্চার দিক হল “ব্রত” পালন। গ্রামবাংলায় এই ব্রত মহিলাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। সাহিত্যভিত্তিক মৌখিক রচনা। শাস্ত্রনুসারে মহিলারা পূজাপাঠে অধিকার পায় না। কিন্তু গ্রামবাংলার বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেমন সুগৃহিণী হবার শিক্ষা, কর্তব্যবোধ, উদারতা, ভক্তি, প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে। আল্পনা বা বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে অনুষ্ঠানগুলোর আকর্ষণ ঘটে এবং গ্রামীণ মহিলাদের একজোট হবার সুযোগও থাকে। বলা যেতে পারে পুরুষশাসিত সমাজের বীরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
দেখা যাচ্ছে লিখিত বা মৌখিক সাহিত্যে সবর্ত্র মন্দাক্রান্তা ছন্দে নারীর প্রবেশ ঘটে চলেছে।
সমাজে নারীর অবদান প্রসঙ্গে বলতে গেলে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে হয়। শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্য ধারাকে প্রাচীনকাল থেকে যারা বহন করে আসছে সেই দেবদাসীরা। কঠোর অনুশীলন এবং নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চা করে গেছে। চতুর্থ শতকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘ দেবদাসী ‘ কথাটি প্রথম পাওয়া যায়। সামাজিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে তিনটি ভাগে বিভক্ত – দেবদাসী ( যারা দেবতার সামনে নৃত্যরত) , রাজদাসী( যারা রাজদরবারে নৃত্যরত )ও স্বদাসী(যারা স্বেচ্ছায় নৃত্য করত)। এছাড়াও আরো বিভিন্ন ভাবে এরা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। কখনো দরিদ্রতা, কখনো বিবাহ না হওয়ায় সমাজচ্যুত হবার ভয়ে , আবার বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি নানান সামাজিক কারণে দাসী শ্রেণীর সৃষ্টি করা হতো। এই দেবদাসীরা ৬৪ কলাবিদ্যায় পারদর্শী হতো। ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যধারাটি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। কিন্তু সমাজ থেকে কোনো সন্মান তারা পায়নি। পুরুষশাসিত সমাজের কাছে তাদের পরিচয় শুধুই ভোগ্যা। মন্দিরকেন্দ্রিক ভারতবর্ষের ভাস্কর্য চিত্রকলাগুলিতে এই দেবদাসীদেরই শিল্প সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।

আরেকটি বিষয় হল,  হিন্দুর আরাধ্যা দেবী  নারী। দেবী দুর্গা। মহা ধুমধামে দেবী দুর্গার আরাধনা চলে পুরুষশাসিত সমাজে। তাঁর পায়ে মাথা নত করতে কোনো দ্বিধা নেই, কিন্তু  মনুষ্য রুপী নারীকে সম্মান প্রদর্শন করতে পুরুষ সমাজের প্রবল আপত্তি। 

                 তৎসত্ত্বেও নারীরা নিজেদের পারদর্শিতার সংসার ও সমাজ সমান তালে রক্ষা করে চলেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। 


                                 বৈশাখী কুন্ডু 
                       গৌড়ীয় নৃত্য সাধিকা।

Related posts

Leave a Comment