29 C
Kolkata
June 16, 2025
Featured

মহাশিবরাত্রিতে নৃত্যশিল্পীরা শিবকে নৃত্যের মাধ্যমে নটরাজ রূপে পূজা করে

ভগবান শিবের আর একটি নাম নটরাজ
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাসে নটরাজ মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে। নৃত্য শাস্ত্রের স্রষ্টা গণ নটরাজ মূর্তিকে নৃত্যের দেবতা মনে করে নৃত্যের মাধ্যমে তাঁর পূজা ও সেবা করে আসছেন। আজও, নৃত্য শিল্পীরা (বিশেষত শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পী) নটরাজকে তাদের আরাধ্য হিসাবে বিবেচনা করে। মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত ক্রমাগত কার্যকলাপের শক্তি নিজেই ভগবান শঙ্করের নৃত্যের মূর্ত প্রতীক। এই নৃত্যের মাধ্যমে নটরাজ নিজেকে পঞ্চক্রিয়ায় গড়ে তোলেন। এই পাঁচটি কর্ম হল সৃষ্টি, স্থিতি ,লয়, তিরোভাব এবং কৃপা। নটরাজের রূপ কল্পনায় বিভিন্ন রূপ দেখা গেছে, যেমন রজ গুণের বিকাশে শিব রূপ, সত্ত্ব গুণের বিকাশে রক্ষাকারী রূপ এবং তমো গুণের বিকাশে ধ্বংসকারী রূপ। ভগবান শিবের তান্ডব হল বিশ্ব সৃষ্টির প্রত্যক্ষ রূপ। সৃষ্টি ,স্থিতি ধ্বংস, তিনটিই তাঁর মধ্যে নিহিত। তাঁর নাচের শব্দে পৃথিবীর ধূলিকণাও জেগে ওঠে। তাই নটরাজকে পুরুষ ও প্রকৃতির সংমিশ্রণ হিসেবে পূজিত করা হয় কখনো তিনি শিব আবার কখনো শক্তি।

যদিও নটরাজের অনেক মূর্তি আছে, কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা দেখতে পাই নটরাজের চারটি হাত। দক্ষিণে এক হাতে ডমরু রয়েছে যা অনন্ত নাদের আকারে অবস্থিত। মাদারির মতো সে তার তালে সারা বিশ্বকে নাচাচ্ছে। শুধু আমরা সকলেই নগণ্য প্রাণীই নয়, সমগ্র মহাবিশ্ব তার ইঙ্গিতে নাচছে। _এটি বিশ্বাস করা হয় যে কথক নৃত্যে “দিগ দিগ দিগ দিগ” বোল শঙ্করের ডমরু নাদ থেকে এসেছে। এটি গুরু বিরজু মহারাজ জী প্রদত্ত তত্ব।বাম হাতে অগ্নিকুণ্ড টি ধ্বংসের প্রতীক। দক্ষিণের এক হাত অভয় মুদ্রায়। অর্থাৎ তিনি সবাইকে ভয় মুক্ত থাকতে বলছেন। তিনি থাকা অবস্থায় একজন সাধক কেন কাউকে ভয় পাবে? এটি শান্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়, একটি হাত বাম দিকে বাঁকানো হয়, যা তার পা নির্দেশ করে। তার মানে তিনি আমাদের সবাইকে তাঁর চরণে আশ্রয় নিতে ইঙ্গিত করছেন। তার চরণে আশ্রয় নিলেই মুক্তি আসে। তিনি তার দক্ষিণ পায়ের নিচে মায়া রূপ অপসমার মৃগী রাক্ষসকে বধ করছেন। অজ্ঞতার অন্ধকার, হিন মানসিকতা, মৃগী এবং কুষ্ঠ রোগের রূপ হল রাক্ষস অপসমার। অজ্ঞতার মাধ্যমেই আমাদের জীবনে দুঃখ, দারিদ্র ,অজ্ঞতা , দুর্বলতা আসে। নটরাজই অজ্ঞতাকে দমন করছেন। বাম পা ঊর্ধ্বমুখী করে বাম হাত দিয়ে পায়ে আশ্রয় নিতে বলছেন। নটরাজের তিনটি চক্ষু তিনটি কালের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে তিনি ত্রিকালদর্শী। মুখ থেকে ওম ধ্বনি দিয়ে সৃষ্টির কাজ করছেন তিনি, এবং আমরা জানি যে ওঙ্কার হলো আদি ধ্বনি। তাঁর থেকেই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় তিনটিই হয়। ভগবান শিবকে ওমকার রূপে ধরা হয়। নটরাজ একটি ঐশ্বরিক আলোর বৃত্তে আবদ্ধ রয়েছেন, একদিকে এই ঐশ্বরিক আলো তার জ্যোতি কে নির্দেশ করে এবং অন্যদিকে এটি একটি অবিচ্ছিন্ন বৃত্ত এবং সৃষ্টি, অস্তিত্ব এবং ধ্বংসের অবিচ্ছিন্ন চক্রের প্রতীক।

যে ভগবান সমগ্র বিশ্বে সর্বব্যাপী বিরাজমান, যাঁর কাছ থেকে সূর্যও আলো পায়, যাঁর কাছ থেকে সমস্ত গ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলী যার ইচ্ছায় তাদের দিক পরিবর্তন করতে পারে, সেই ভগবান শিব নটরাজকে যুগ যুগ ধরে নৃত্যশিল্পীরা একটি শ্লোক এর মাধ্যমে বন্দনা করেছেন। “অভিনয় দর্পণ”-এ উল্লেখ করা হয়েছে
অঙ্গিকম ভুবনম যস্য বাচিকম সর্ব বাঙ্গময়ম আহার্যম চন্দ্র তারাদি তম নমঃ (বা বন্দে) স্বাত্বিকম শিবম।”
অর্থাৎ সমস্ত জগৎ যাঁর দৈহিক প্রকাশ, যাঁর বাণী (ওম কার) বায়ু তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে, যাঁর অলঙ্কার চন্দ্র-নক্ষত্র, সেই এক(অদ্বিতীয়) সত্ত্ব গুণী (ত্রিগুনাতিত) কাল জয়কারি, শিব কে আমার প্রণাম।

ভারতে অবস্থিত সমস্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীতে নটরাজকে নৃত্যের মাধ্যমে পূজা করা হয়। প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্য শিব থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্রে এমনটাই বলা হয়েছে। সঙ্গীতে (গীত, বাদ্য এবং নৃত্য)ব্যবহৃত তাল এর অর্থ সময় বা একটি নির্দিষ্ট সময় চক্র। এই সময় অর্থাৎ কাল, এই কাল চক্রের শাসক হলেন মহাকাল । আমরা সকলেই জানি যে সময়ের দেবতা হলেন মহাকাল। সমস্ত কিছুকে এক নির্দিষ্ট সময় গ্রাস করে। সেই সময়ের অধিপতি হলেন মহাকাল।তাল এক একটি সময় চক্রে আবদ্ধ।যেমন ১৬টি মাত্রা তিন তাল, ১০টি মাত্রা ঝাপতাল ইত্যাদি। যে প্রস্তুতিই দেখানো হোক না কেন, এই সময় চক্রের মধ্যেই দেখাতে হবে। তালের প্রথম মাত্রা হল সম। উপস্থাপনা সম থেকে শুরু হয় এবং শেষ হয় সম দিয়ে। অর্থাৎ ১ মাত্রায় থেকে শুরু করে ১মাত্রায় শেষ হয় ।মানুষের জীবনও একটি সময় চক্রে বাঁধা। এক মুহূর্তও তার চেয়ে কম বা বেশি কেউ বাঁচতে পারে না। আমরাও এক ( ঈশ্বর) থেকে আসি এবং এক মিলিয়ে যাই। এই সময়ের চক্রের প্রতীক হল নটরাজের চারপাশে আগুনের বৃত্ত যা অবিরত ঘুরতে থাকে। ভগবান নটরাজ স্বয়ং সম (তালের প্রথম বা নম্বর ১নং মাত্রা) রূপে আছেন। আগুনের বৃত্ত তাঁর থেকে শুরু হয় এবং এবং তাঁর মধ্যেই শেষ হয় । তাল ও একই দিয়ে শুরু হয় এবং একই দিয়ে শেষ হয়, জীবনও তাঁকে দিয়ে শুরু হয় এবং তাঁর মধ্যেই শেষ হয়। অর্থাৎ, নৃত্যে ব্যবহৃত উপস্থাপনাগুলি শিবের রূপ থেকে শুরু হয় এবং শিবের মধ্যেই শেষ হয়।কেবলমাত্র ছন্দে নিমগ্ন হয়েই নৃত্য পরিবেশন করা হয়, যদি একটি বিন্দুতে মনোযোগ সরে যায় তবে তা ছন্দের বাইরে চলে যায়। ছন্দের বাহির মানেই স্বাদের বিলুপ্তি।এই সময় চক্রকে (তাল) মাথায় রেখে আমরা নৃত্যের মাধ্যমে মহাকালকে আরাধনা করি।

যদিও প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্যে তাল ব্যবহার করা হয়, কিন্তু উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী কথক দেখলেই বোঝা যায় যে তাল আসলে কী? কারণ কথক একটি ছন্দ ভিত্তিক নৃত্য। পূর্ণাঙ্গ লয়কারি দেখানো হলেই তার পর ভাব দেখানো হয়, একথা আমরা সবাই জানি ভাবে একাকার না হলে ভাব দেখানো সম্ভব নয়।তাই বলা হয় একজন নৃত্যশিল্পী স্বল্প সময়ে ঈশ্বরকে পেয়ে যান। ভগবানকে পেতে হলে একীভূত অনুভূতি থাকা দরকার (একহম দ্বিতিও নাস্তি) তা ছন্দে হোক বা ভাবে। তাল বা ছন্দও আমি এবং ভাব এর চরিত্রও আমি। এই ভাবনা নিয়েই নৃত্যে করতে হয়। তবেই একজন নৃত্যে শিল্পী সার্থক নৃত্যে হয়ে উঠতে পারেন।

আমাদের সনাতন শাস্ত্রে ভগবান শিবকে আদি গুরু বলা হয়েছে।তিনি প্রতিটি জ্ঞানের শিক্ষক। স্কন্দ পুরাণ, শিব পুরাণ এবং দেবী ভাগবতে, শিব নৃত্য আদি সমস্ত জ্ঞানের গুরু বলা হয়ছে।গুরু যেমন জ্ঞান দান করেন, অন্যদিকে অজ্ঞানকেও নাশ করেন। ভগবান নটরাজের পায়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা অসুরের নাম অপস্মার। এর অপর নামও মুয়ালকণ। অপস্মার হল একটি বামন রাক্ষস যাকে অজ্ঞতা এবং বিস্মৃতির জনক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি রোগের প্রতিনিধি হিসাবেও বিবেচিত হয়। আজও মৃগী রোগকে সংস্কৃতে অপসমার বলা হয়। যোগব্যায়ামে নটরাজাসন নামে একটি আসন রয়েছে যা নিয়মিত অভ্যাস করলে মৃগীরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নটরাজ আসনের বিভিন্ন ভঙ্গি রয়েছে। নাট্যশাস্ত্র এবং অভিনয় দর্পণে নটরাজের বিভিন্ন ভঙ্গিকে “করণ” বলা হয়েছে। এই “করণ “এখনও চিদাম্বরমের মন্দিরে খোদাই করা শিল্পের আকারে বর্তমান। কথক নৃত্যে, কিছু করণ কথকের নিজস্ব পরিভাষার নামের সাথে ব্যবহার করা হয় (গুরু বিরজু মহারাজ জি প্রদত্ত নাম)। বৃশ্চিক করণ যেমন উড়ান নামে পরিচিত, ভুজঙ্গত্রাসিত করণ অধর পদনামে পরিচিত ইত্যাদি।

একটি কাহিনী অনুসারে, অপ্সমার ছিলেন একজন বামন রাক্ষস যিনি নিজেকে সর্বশক্তিমান এবং অন্যকে নিকৃষ্ট মনে করতেন, স্কন্দপুরাণে তাকে অমর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তার ক্ষমতা দিয়ে যে কারো চেতনা কেড়ে নিতে পারেন এমন বর পেয়েছিলেন। তাকে অসাবধানতা এবং মৃগীরোগের ,কুষ্ঠ রোগের প্রতিনিধিও মনে করা হয়। এই শক্তির কারণে সে একদা মৃগী ও কুষ্ঠ রোগ সবাইকে পীড়িত করতে থাকে। এর প্রভাবে মানুষ মৃগী বা কুষ্ঠ রোগে ভুগতো এবং অনেক কষ্ট করতো। সে তার ক্ষমতা এবং অমরত্ব নিয়ে গর্বিত ছিলো। সে বলতো, তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারবে না।

একবার অনেক ঋষি নিজ নিজ স্ত্রীদের নিয়ে যজ্ঞ ও সাধনা করছিলেন।তাঁরা তাঁদের ত্যাগ ও কৃতিত্বের জন্য গর্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে পৃথিবী কেবল তাঁদের শক্তি অর্জনের ফলের উপর নির্ভরশীল। একদা ভগবান শঙ্কর এবং মাতা পার্বতী ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হন তখন সমস্ত ঋষিপত্নি তাদের প্রণাম জানাতে যজ্ঞ ত্যাগ করেন। এতে ওই ঋষিরা খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাদের সিদ্ধির সাহায্যে তারা অনেক বিষাক্ত সাপ তৈরি করেছিলেন এবং তাদের ভিক্ষুক রূপে মহাদেবকে আক্রমণ করতে বলেছিলেন। কিন্তু ভগবান শঙ্কর সমস্ত সাপকে ধ্বংস করেছিলেন। তখন সেই ঋষিরা সেখানে উপস্থিত এই রাক্ষসকে তাদের আক্রমণ করতে বললেন। স্কন্দপুরাণেও উল্লেখ আছে যে একই ঋষিরা তাদের সিদ্ধির মাধ্যমে অপসমার কে সৃষ্টি করেছিলেন। অপসমার তাদের উভয়কেই আক্রমণ করে এবং তার শক্তি দিয়ে মা পার্বতীকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে চেতনা হরণ করে ফেলে যার ফলে মা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই দেখে ভগবান শঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন এবং তিনি তার ডমরু ১৪বার বাজালেন। রাক্ষস সেই ভয়ানক শব্দ সইতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অতঃপর তিনি অতিপ্রাকৃত নটরাজের রূপ ধারণ করেন এবং অপ্সমারকে পায়ের তলায় চেপে নাচতে থাকেন। ভগবান শঙ্কর নটরাজ রূপে অপসমার সমস্ত শক্তিকে এক পা দিয়ে চেপে এবং অন্য পা তুলে দিয়ে নিজেকে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল করে তোলেন। কিন্তু তিনি তাকে হত্যা করেননি, কারণ প্রথমত, সে ছিলো অমর এবং দ্বিতীয়ত, তার মৃত্যুর পর পৃথিবী থেকে অজ্ঞতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যার ফলে যেকোনো জ্ঞান অর্জন করা খুব সহজ হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা অর্জনের সম্মান হারিয়ে ফেলবে।

ঋষিরা ভগবান শঙ্করের সেই রূপ দেখেন । যায় ফলে তাদের অহংকার দূর হয়ে গেল এবং তারা বারবার তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন। একইভাবে, তারা অপসমার কে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য প্রার্থনা করেছিল যাতে ভবিষ্যতে বিশ্বের কেউ এর ক্ষমতার প্রভাবে না আসে। নটরাজের রূপে মহাদেব, তার ডমরুর ধ্বনি ১৪বার করেছিলেন । তাকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, মহর্ষি পাণিনি ১৪টি সূত্রের সমন্বয়ে রুদ্রাষ্টধ্যায়ী মাহেশ্বর সূত্র রচনা করেন।

সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সূত্র এই ১৪টি সূত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে। এটির ৮টি অধ্যায় রয়েছে এবং এই আটটি অধ্যায়ে ১৪টি সূত্র বর্ণনা করা হয়েছে। যাকে আমরা শিব সূত্র, প্রত্যাহারী সূত্র বা পাণিনি সূত্র বলে জানি।

আর একটি ঘটনা অনুসারে একবার ভগবান শঙ্করের এক অদ্ভুত নৃত্যের ইচ্ছা জেগেছিল তাঁকে দেখার জন্য সমস্ত দেবতা, যক্ষ, ঋষি, গন্ধর্ব প্রভৃতি কৈলাসে সমবেত হন। মহাকালী নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন। দেবী সরস্বতী পূর্ণ ভক্তি সহকারে তার বীণা বাজানো আরম্ভ করলেন, ভগবান বিষ্ণু মৃদঙ্গ বাজানো শুরু করলেন, মা লক্ষ্মী গান গাইতে লাগলেন, পরম পিতা ব্রহ্মা হাত দিয়ে প্রহার শুরু করলেন অর্থাৎ তাল রাখলেন,ইন্দ্র মুরলি বাজাতে লাগলেন এবং অন্যান্য দেবতারা বিভিন্ন যন্ত্র থেকে ছন্দময় ধ্বনি উৎপন্ন করলেন। তখন মহাদেব নটরাজের রূপ ধারণ করে এমন অপূর্ব নৃত্য করলেন যা আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। সেই সুন্দর নাচ দেখে সবাই অভিভূত হয়ে গেলেন।নাচ শেষ হলে সবাই মিলে মহাদেবকে ধন্যবাদ জানাল। মহাকালী খুব প্রসন্ন হয়ে বললেন-প্রভু! তোমার নাচ দেখে আমি এত প্রসন্ন হয়েছি যে তোমাকে বর দেওয়ার মতো মনে হচ্ছে। সুতরাং, দয়া করে আমার কাছ থেকে একটি বর চাও। তখন মহাদেব বললেন-দেবী! আমার নৃত্যে যেমন তোমরা সকল দেবতা আনন্দিত হলো, তেমনি পৃথিবীর সকল প্রাণীও আনন্দিত হোক, এটাই আমার কামনা। এখন আমি তান্ডব থেকে দূরে থাকতে চাই এবং শুধু রাস( লাস্য )করতে চাই। এই কথা শুনে মহাকালী সমস্ত দেবতাকে পৃথিবীতে অবতরণ করার আদেশ দিলেন এবং নিজে শ্রীকৃষ্ণের অবতার গ্রহন করে বৃন্দাবনে এলেন। ভগবান শঙ্কর রাধার অবতার গ্রহন করেন এবং তারপর উভয়ে একসাথে দেবদুর্লভ মহারাস করেন।এই কারণেই দেবী ভাগবতে শ্রী কৃষ্ণকে মা কালীর অবতার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

একটি কিংবদন্তি অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় যে বিষ উঠেছিল তা পানের জন্য কেউ উপযুক্ত ছিল না। অতঃপর ব্রহ্মার নিজের যোগশক্তিতে চার বটুক ব্রহ্মচারীর জন্ম হয়, যাদের নাম ছিল সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমার। এই চারজন বিষের ভাণ্ডার নিয়ে গেল কৈলাসে। ভগবান বিষ গ্রহণ করলেন এবং গলায় রেখে তিনি নীলকন্ঠের রূপ ধারণ করলেন।বিষের প্রভাবে ব্যথা হচ্ছিল তাঁর। ভগবতীর দুধ পান করার পর ব্যথা কিছুটা কমলে নৃত্যে আরম্ভ করলেন নৃত্য শেষে এই চারজনকে খালি হাতে না ফেরার চিন্তা এলো। তারপর ১৪ বার ডমরুর ধ্বনি তৈরি করলেন এবং সেই ধ্বনি থেকে ১৪টি সূত্র বের হয় যা এই চারজন কে ব্যাকরণ সূত্র আকারে দেওয়া হয়েছিল। তাই সংস্কৃত ভাষাকে ধ্বন্যাত্মক ভাষা বলা হয়। “নৃত্যবসানে নটরাজ ননাদ ঢক্কা নবপঞ্চবারম, উদ্ভুর্তুকাম সনকাদি সিদ্ধান ইতদ দ্বিমর্শে শিবসূত্র জালম।

এ তো হলো বেদ পুরাণের কথা।যদি আধুনিক যুগের
দিকে দেখি, আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা আপনাদেরকে বলছি। আমরা 2014 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেনারসে উপস্থিত ছিলাম। আমরা যে হোটেলে বাঙ্গালী টোলায় থাকতাম সেই একই হোটেলে আরেকটি পরিবার এসেছিল। বাবা-মা ও তাদের দুই সন্তান। ওই শিশুরা মৃগীরোগে ভুগছিল। কোন ডাক্তার তাদের দুজনকেই সুস্থ করতে পারেনি। আমাদের কথোপকথনের সময় আমরা জানতে পারি যে এরা আহমেদাবাদের বাসিন্দা ছিল। তাদের কাছে একটি সংবাদপত্রের কাটা অংশ ছিল। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাবা কাশী বিশ্বনাথকে দেওয়া সিদ্ধির (ভাং)প্রসাদ যদি দুধের সঙ্গে মিশিয়ে কোনো মৃগী রোগীকে দেওয়া হয়, তাহলে মৃগীরোগ সেরে যায়। একই বিশ্বাস নিয়ে এরা বাবার দরবারে এসেছে। আর আমরা আগেই বলেছি অপসমার রোগ মৃগী রোগের প্রতীক। মৃগী রোগকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় অপসমার। প্রসাদ অর্থাৎ করুণার মাধ্যমেই মৃগীরোগ থেকে মুক্তি পান আজও। তাহলে এটা কি প্রমাণিত নয় যে নটরাজকে যথাযথভাবে আরাধনা করলেই সকল বাধা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? সেটা নাচের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো মাধ্যমে। গন্তব্য একই শুধুমাত্র পথ টি ভিন্ন। স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ আছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের (গীত , বাদ্য,নৃত্য) মাধ্যমে ঈশ্বর প্রাপ্তি সম্ভব।নৃত্য ঈশ্বরের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়, সেজন্য তিনি কখনও নটরাজ, কালিকা, নটবর কৃষ্ণ এবং কখনও রাধা রূপে নৃত্যকে পৃথিবীতে প্রচার করেছেন। কাশী নটরাজের শহর, তাই নৃত্যের শহর কথকের শহর। আর আমার মতে, কথক সহ সমস্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী যে সম্মান বেনারসে পায় তা আর কোথাও পাওয়া যায় না।

অনেক গুনীজন,অনেক ঋষি মুনির মতে নৃত্য ছাড়া শিব পূর্জা সপন্ন হয় না। কারণ তিনি নটরাজ। তাহলে এই মহাশিবরাত্রীতে যেখানেই শিব আরাধনা হবে সেখানেই কোনো গুরু শিষ্য পরম্পরায় শিক্ষা প্রাপ্ত নৃত্য শিল্পী দিয়ে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রস্তুতি অনিবার্য।।

ছবিতে কথক নৃত্য শিল্পী কৌশিক মাইতি।

Related posts

Leave a Comment