বনগাঁর ঠাকুরনগরের মতুয়াবাড়িতে ঠাকুর পরিবারের অন্দরের দ্বন্দ্ব আবারও প্রকাশ্যে এসেছে—এবার দুই ভাই, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর ও গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুরের মধ্যে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় নাটমন্দিরে শান্তনুর অনুগামীদের এক বিশেষ শিবির আয়োজনকে ঘিরে। সুব্রত তার প্রতিবাদ জানান, কারণ নাটমন্দিরে নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়, সেখানে রাজনৈতিক শিবিরে সমস্যা হতে পারে বলে তাঁর যুক্তি। কিন্তু শান্তনুপন্থীরা অভিযোগ তুলেছেন, সুব্রত গিয়ে মতুয়া ভক্তদের হুমকি দিয়েছেন। পাল্টা, সুব্রত অভিযোগ করেছেন—শান্তনু ঠাকুরবাড়ির ক্ষমতা দখল করতে চাইছেন।
এই বিরোধে পরিবার ভেঙে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছে। সুব্রতের পাশে রয়েছেন মা ছবিরানি ঠাকুর, তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর ও তাঁর কন্যা বিধায়ক মধুপর্ণা ঠাকুর। অন্যদিকে, শান্তনুর পাশে দাঁড়িয়েছেন বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর।
বিজেপি নেতৃত্ব আপাতত দূরত্ব বজায় রাখছে। দলীয় সূত্রে খবর, রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী—সকলেই এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না করার নির্দেশ দিয়েছেন। দলের যুক্তি, দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ—একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অন্যজন বিধায়ক। তাই কারও পক্ষে দলীয় অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এটি ঠাকুরবাড়ির দীর্ঘ দিনের পারিবারিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা মাত্র। অতীতে কপিলকৃষ্ণ ও মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বিবাদ কিংবা মমতাবালা বনাম সুব্রত-শান্তনু সংঘাত এর প্রমাণ। ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগেও দুই ভাইয়ের মধ্যে অস্থায়ী মতভেদ তৈরি হয়েছিল, তবে তা দ্রুত মিটে গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে, বর্তমান সংঘাতও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
বিজেপির নীরব কৌশল
এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে মন্তব্য না করার কৌশল নিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। কারণ, শান্তনু যেমন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তেমনি সুব্রত একজন সক্রিয় বিধায়ক। দু’জনেই দলের কাছে জরুরি। প্রকাশ্যে পক্ষ নিলে একাংশ অসন্তুষ্ট হতে পারে, যা লোকসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই রাজ্য নেতৃত্ব আপাতত অপেক্ষার কৌশল নিচ্ছে।
মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের তাৎপর্য
বাংলার নির্বাচনে মতুয়া সমাজ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। বনগাঁ ও উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক আসন মূলত মতুয়া ভোটেই নির্ভরশীল। বিজেপি গত কয়েক বছরে মতুয়াদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করলেও নাগরিকত্ব আইন (CAA) কার্যকর না হওয়ায় হতাশা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই ঠাকুর পরিবারের অন্দরের দ্বন্দ্ব বিজেপির অস্বস্তি বাড়াতে পারে।
রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ
বিজেপির লাভ-ক্ষতি: যদি শান্তনু–সুব্রতের দ্বন্দ্ব গভীর হয়, তবে বিজেপি একাংশ সমর্থন হারাতে পারে। তবে পারিবারিক বিরোধ অতীতে ক্ষণস্থায়ী হয়েছে বলেই দলের আশা, এ বারও তা দ্রুত স্তিমিত হবে।
তৃণমূলের সুযোগ: সুব্রতের পাশে দাঁড়ানো মমতাবালা ও মধুপর্ণা এই দ্বন্দ্বে তৃণমূলকে বাড়তি রাজনৈতিক অস্ত্র দিচ্ছে। বিজেপির ভাঙন দেখিয়ে তৃণমূল মতুয়াদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চাইবে।
মতুয়া সমাজের অবস্থান: দীর্ঘদিন ধরেই ঠাকুর পরিবারের ভেতরের কলহে বিভক্তি স্পষ্ট। তাই সমাজের ভোট মেরুকরণও দ্বন্দ্বের ওপর নির্ভর করবে। তবে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নে—CAA কার্যকর হওয়া না হওয়া—এখনও মতুয়া ভোট নির্ধারণের বড় ফ্যাক্টর।
সব মিলিয়ে, ঠাকুরনগরের এই গৃহদ্বন্দ্ব আপাতত বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেললেও, দলীয় নেতৃত্বের বিশ্বাস—অতীতের মতো এ বারও ঠাকুর পরিবারে মিটমাট হবে। তবে যদি না হয়, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটে বনগাঁ ও সংলগ্ন অঞ্চলে এর বড় প্রভাব পড়তে পারে।