মিলন খামারিয়া, কল্যাণী, ১৫ জুন: গতকাল ও আজ(১৪ ও ১৫ ই জুন) দু’দিন ধরে বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেল উদ্যানজাত ফসলের মেলা। গত বছর বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সুবর্ণ জয়ন্তী(৫০ বছর পালন)’ পালন উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল এক বিরাট কৃষি মেলা। এ বছরও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন কৃষি পণ্য, বীজ, কীটনাশক, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার; কৃষিপণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্য, যেমন- নারকেলের বিভিন্ন অংশ দিয়ে আসবাব পত্র ও নারীদের সজ্জার সামগ্রী; উদ্যানজাত ফসলের প্রদর্শনী ও পুরস্কার প্রদান ইত্যাদি মিলিয়ে হল কৃষক প্রশিক্ষণ ও কৃষি মেলা।
গতকাল প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যেমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘কৃষি প্রদর্শনী এবং উদ্যান ফসল সংক্রান্ত মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচী’ ও ‘আধুনিক উদ্যানপালন এবং উদ্যোক্তা বিকাশ বিষয়ক রাজ্যস্তরীয় আলোচনা সভা’র আয়োজন করা হয়।
এই সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অশোক কুমার পাত্র, ‘উদ্যান বিজ্ঞান অণুষদ’-এর অধ্যক্ষ জীতেশ কুমার হোড়, অনুষ্ঠানের অর্গ্যানাইজিং সেক্রেটারি এ.কে. বণিক, মূখ্য অতিথি হিসাবে উপস্থিত হয়েছিলেন নদিয়া জেলার সভাধিপতি তারান্নুম সুলতানা মীর ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বীজ প্রমুখ শুভাশিস বটব্যাল; প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন ‘প্রাণী ও মংস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’-এর উপাচার্য ড. তীর্থ কুমার দত্ত, ড. প্রদীপ দে( Director,ICSR-ATARI,Kolkata) ও আরও অনেকে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ডিরেক্টর অফ এগ্রিকালচার’-এর আধিকারিক দীপ্তেন্দু বেরা বলেন, চাষি ভাইরা যদি ভালো থাকেন তাহলে আমরা সবাই ভালো থাকব। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপাদিত বীজ ও প্রযুক্তি আমরা চাষিদের কাছে পৌঁছে দেব, যাতে তাদের সীমিত জমিতে চাষ করেও তাদের আয় আরও বাড়াতে পারেন। কৃষিকাজের মধ্যে উদ্যানজাত ফসলের আয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু খাবার খেয়ে পেট ভরালেই হবে না, তার পুষ্টিগুণও দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে উদ্যানজাত ফসল অর্থাৎ ফল ও সব্জির গুরুত্ব বেশি।
ড. প্রদীপ কুমার বলেন, উদ্যানজাত ফসলের প্রক্রিয়াকরণে গুরুত্ব দিতে হবে, তাতে চাষিদের আয় বৃদ্ধি হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ফল গবেষণা কেন্দ্র খুব ভাল কাজ করছে তা আমি নিজে দেখে এসেছি।
বীজ প্রমুখ বটব্যাল বলেন, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীরা শুধু এই রাজ্য বা দেশ নয়, পৃথিবীতে ভারতের সুনাম বাড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় যে বীজ ও প্রযুক্তি তৈরি করছে তা চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে চাষাবাদ করতে হবে।
উপাচার্য অধ্যাপক অশোক কুমার বলেন, এক একর জমিতে ধান, গম, ভুট্টা চাষ করে হয়তো ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা পাওয়া যায় কিন্তু উদ্যানজাত ফসলের চাষ করলে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে। সেই প্রযুক্তি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। সেটাকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াতে পারি, সেই দিশাতেই আমরা দু’দিনের প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছি। উদ্যানজাত ফসল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, তাকে কীভাবে দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়, সেই চেষ্টাও আমরা করছি।
সভাধিপতি তারান্নুম বলেন, যারা সারাদিন পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলান আমি আন্তরিক ভাবে তাদের শ্রদ্ধা জানাই। চাষ ছাড়া আমরা কেউ বাঁচতে পারব না। কিন্তু সেই চাষের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনের আগত প্রজন্মের কাছে আমরা কী রেখে যাবো তাহলে? পাশাপাশি বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষাবাদ করতে হবে আর ভূ-গর্ভস্থ জল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে চাষাবাদের কাজে। না হলে ভবিষ্যতে বড়ো বিপদের সম্মুখীন হবো আমরা।
উপাচার্য তীর্থ কুমার বলেন, প্রাণীজ সম্পদকে সরাসরি বিক্রি না করে তা যদি প্রক্রিয়াকরণ করে বিক্রি করা যায় তাহলে লাভ বেশি হবে।যেমন, দুধ বিক্রি হয় ৫০-৬০ টাকা লিটার। ১ লিটার দুধ থেকে ৩০০ গ্রাম পনীর হয়। তাহলে উৎপাদন মূল্য মিলিয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি খরচ হয় অথচ ৪০০ টাকা কেজি পনীর বিক্রি করা যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে চাষিভাইদের লাভ বেশি হবে।
এই মেলা উপলক্ষে অনেকগুলি বই প্রকাশ করা হয়।
১) ‘Diabetic Friendly Fruits: Smart Choices for Sweet Health’: – লেখকবৃন্দ হলেন T.P.Thakur, Prof.P. Datta, Prof. S. Kundu, and F.K.Bauri ( ইংরেজি ভাষায় লেখা)
২) ‘Intellectual Property Rights’:- লেখকবৃন্দ হলেন – Prof. S. Mukherjee, A. Mukherjee and M. Barman ( ইংরেজি ভাষায় লেখা)
৩)’Arsenic in Ground Water – Poison, Man and Ecology’, ‘Migration in Social Ecology of North East Himalayas of Visualization to Mental Modelling’, ‘Self Help Group: The income Interprise and Ecology’, Social Ecology of Waste Management – Approach, Process and Impact’:- এই চারটি বইয়ের লেখক Prof. S. K. Acharya (ইংরেজি ভাষায় লেখা)
৪)’District Wise Atlas of Available Macronutrients and Sulphur Status in Soils of West Bengal’:- Prof. G.C. Hazra and Others (বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা)
৫)Improved Technology for Production of Tuber Crops:- Prof. S. Maitra (বাংলা ভাষায় লেখা)
৬)Preservation of Fruit and Vegetable:- Mr. S. Das(বাংলা ভাষায় লেখা)
এই উদ্যান মেলা ও কর্মশালা প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ জীতেশ কুমার হোড় বলেন, ভারতীয় কৃষিতে ফল, সব্জি, ফুল, মশলা, সুগন্ধি গাছপালা, ঔষধী শস্য, আবাদি ফসল, মাশরুম ও অন্যান্য উদ্যানজাত ফসলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আর অনুসারী হিসাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের রাজ্য বিভিন্ন উদ্যানজাত ফসল উৎপাদনে দেশের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উদ্যান বিজ্ঞান অণুষদ’-এর ব্যবস্থাপনায় ১৪-১৫ ই জুন, দুই দিন ব্যাপী উদ্যান বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকের প্রদর্শনী ও মানব সম্পদ উন্নয়ন শীর্ষক যে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল কৃষকভাই ও বোনেদের আধুনিক কৃষি উপকরণ ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এই কর্মশালায় পার্শ্ববর্তী ৬ টি জেলা থেকে আগত প্রায় ৪০০ কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। উদ্যোগ বিজ্ঞান প্রদর্শনী সাজানো হয়েছিল ৩৫ টি দোকান দিয়ে। এই উপলক্ষে ৩৪ টি গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্য সম্বলিত নিবন্ধ সমৃদ্ধ ‘আধুনিক উদ্যান বিজ্ঞান প্রযুক্তি’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, যা আশাকরি সবার কাজে লাগবে। আগামী দিনে এমন কর্মশালা ও উদ্যান মেলা আমরা আরও আয়োজন করব, যাতে অন্নদাতা কৃষকদের উপকার হয়। তারা ভালো থাকলে তবেই সমাজের সব মানুষ ভালো থাকবেন ও সমাজ উন্নত হবে।
previous post