November 1, 2025
Featured

অপাঙক্তেয়- সময়ের দাবির নাটক

নাট্য সমালোচক মিলন খামারিয়া

‘অপাঙক্তেয়’ অর্থাৎ The Uncountables – হল তারা – যারা অপ্রয়োজনীয় বা গুনতিতে আসে না।পশ্চিমবঙ্গ-বিহার বর্ডারের সীমান্তে একটি ইঁট ভাটাকে কেন্দ্র করে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের মানুষদের সাথে বাস করেন একজন হাতুড়ে ডাক্তার। গ্রামের লোকেরা তাকে বলেন ‘ডাগদার’। ডাক্তারকে তারা টাকা দিতে পারে না, তার বদলে খেতের আলু, বেগুন – সব্জি দেয়। ডাক্তার তাদেরকে ফিজিশিয়ান স্যাম্পেল হিসেবে পাওয়া ওষুধ দেন যা তাকে এনে দেয় একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ অলোক।প্রতি মাসে একবার ক’রে তার সহকর্মী বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ওষুধ দিতে আসেন ডাক্তারকে। আসেন, ডাক্তারের সাথে গল্প করেন। ডাক্তারের কথা শুনে অলোকের মনে হয় যে, ডাক্তার অনেক জ্ঞানী। কিন্তু এমন হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে গ্রামে কেন থাকেন তিনি, এইডস রোগের ওষুধই বা কাকে দেন ডাক্তার? প্রশ্ন জাগে তার মনে। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করেন নি ডাক্তারকে।

অলোকের ভালো লাগে ডাক্তারের সাথে গল্প করতে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ডাক্তারের সাথে কথা বলেন, মেশেন, স্যাম্পেল ওষুধ দেন তাদেরকে। কিন্তু তার কোথাও মনে হয়, ডাক্তারদের মধ্যে যেন ‘সেবা’ করার মানসিকতা হারিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামের এই ডাক্তারের মধ্যে খুঁজে পান সেবার ভাবনা। তাই মাসে একবার করে আসেন এখানে।একদিন শহর থেকে ডাক্তারের আসছিল অলোক। হটাৎ তার স্কুটির চাকা পাংচার হয়ে যায়। সে আর সেদিন শহরে ফিরতে পারে না। ডাক্তারের সাথেই থেকে যায় সে।বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পুরনো দিনের গল্প-গানে আসর যখন জমে উঠেছে তখন হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয় রাণী। রাণী হল বাগী। রাণী সন্দেশখালির মেয়ে। সে এক মুসলিম ছেলের লাভ জেহাদের শিকার হয়ে, হাত বদল হতে হতে এই গ্রামে এসে উপস্থিত হয়।

নাচ-গান জানা রাণী তারপর গ্রামে ইঁট ভাটার মালিক দেবীপ্রসাদের রাখেল হয়ে থেকে যায়।২০০৮-০৯ সালের দিকে সেই গ্রামে এক দল লাল ঝান্ডাধারী লোক এসে পৌঁছায়। তারা ইঁটভাটার শ্রমিকদের বোঝায় যে, মালিক তাদের ঠকাচ্ছে। উপযুক্ত মজুরি দিচ্ছে না। একই ভাবনায় ভেবে তাদের সাথে প্রতিবাদে সামিল হয় রাণী। সে তার গয়না বেচে ইঁট ভাটার শ্রমিকদের সাহায্য করতে শুরু করে কিন্তু জেনে যায় দেবীপ্রসাদ। ইঁট ভাটার দশ জন শ্রমিককে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয় দেবীপ্রসাদ। আর পাঁচ জনকে পাঠায় রাণীকে ধর্ষণ করার জন্য, যার মধ্যে একজন ছিল এইডস আক্রান্ত। সেখান থেকেই রাণীর শরীরে বাঁধে মারণ রোগ।প্রতিশোধ নিতে রাণী দেবীপ্রসাদকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়। রাণী এখন বাগী।

বর্তমানে দেবীপ্রসাদের ছেলে ও তার সাকরেদরা শাসন করছে গ্রাম।রাণীর সাথে থাকে লছমন। তার হাতে গুলি লেগেছিল আন্দোলন করতে গিয়ে। হাসপাতালে যেতে পারে না লছমন ভয়ে। সেই হাত দেখাতেই সে মাঝে মাঝে আসে ডাক্তারের কাছে, যাতে সেপ্‌টিক না হয়ে যায়। সেই রাতে রাণী ও লছমনের সাথে মিশে অলোক অবাক হয়। মানুষ এমন ভাবেও বাঁচে!রাতে হঠাৎ আসে ভিকু। তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে। তার আট বছরের ছোটো মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে। অসহায় অবস্থায় নিয়ে আসে ডাক্তারের কাছে। কিন্তু শতছিন্ন যোনী দেখে ডাক্তার অসুস্থ বোধ করেন, সেলাই করতে পারে না। অলোক অবাক হয়!কিন্তু অলোকের মা তাকে সব কাজ শিখিয়েছিল। মেয়েটিকে বাঁচাতে সে যোনী সেলাই করে কোনোরকমে, পেছন থেকে ডাক্তার বলে বলে সাহায্য করে মুখ ঘুরিয়ে।

মেয়েটির রক্ত বন্ধ হয়।জানা যায় দেবীপ্রসাদের ছেলে ও তার সাকরেদরা মিলে ধর্ষণ করেছে এই শিশুকে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া উচিত মনে করে সবাই।অলোক ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, কেন আপনি এমন করলেন, সেলাই করলেন না কেন? ডাক্তার তার পুরনো জীবনের কথা বলে। বলে যে – সে ছিল কলকাতার নামি হাসপাতালের চিকিৎসক পড়ুয়া। জীবনে সে কোনোদিন দ্বিতীয় হয়নি। তার সাথে আলাপ হয় হৈমন্তীর। মেয়েটি ছিল তার চেয়েও মেধাবী। ডাক্তার তার প্রেমে পড়ে যায়। হৈমন্তী প্রতিবাদী মেয়ে। সব কিছুতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই প্রতিবাদে সিস্টেমের লোকেদের অসুবিধা হতে থাকে। জুনিয়র-সিনিয়র দশজন ডাক্তার মিলে হাসপাতালের মধ্যেই হৈমন্তীকে ধর্ষণ করে। সেটাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য করে ডাক্তারকে।চোখ যাতে বন্ধ করতে না পারে তার জন্য চোখে স্পেকুলাম লাগিয়ে দেয় ডাক্তারের চোখে। তারপর হৈমন্তীর শতছিন্ন যোনী সেলাই করতে বলে ডাক্তারকে।

সেই ঘটনায় ডাক্তার এতো ভীতু হয়ে যায় যে – সে পড়াশোনা ছেড়ে পালাতে পালাতে এসে পৌঁছায় এই গ্রামে। সে হৈমন্তীকে বাঁচাতে পারেনি, পারেনি দোষীদের শাস্তি দিতে। রয়ে যায় পাপবোধ ও ভয়। তাই আজ সে পারে না সেলাই করতে।ডাক্তার ভাবে এই ভাবে চলতে পারে না, দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে সমস্যা কোনোদিনও মিটবে না। রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ডাক্তার।সকালে ধর্ষিত মেয়েটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে অলোক যখন তার পাংচার হয়ে যাওয়া স্কুটি ঠেলে নিয়ে যায়, দেখতে পায়- রাস্তার ওপর দুটি লাশ পড়ে রয়েছে। অলোক ভাবে এটা হয়তো ডাক্তার করেছে। কিন্তু দেখতে পায় পাশে পড়ে থাকা একটি হার, যেটা রাণী পরে থাকত গলায়। সেই হার পুড়ে নেয় নিজের পকেটে অলোক, প্রমাণ লোপাট করতে। বেজে ওঠে পুলিশের গাড়ির সাইরেন। মঞ্চে দেখা যায় ডাক্তার বসে আছে তার জায়গায়, চা খাচ্ছেন।নাটকের নাম ‘অপাঙক্তেয়’ কেন? জানতে চাইলে নাট্যকার ও নির্দেশক মনোজ কুমার সাহা তথা আবির বলেন, বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের এই শব্দটি মানুষ বিস্মৃত হলেও, যাদের জন্য এই শব্দ ব্যবহৃত হয়; প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো সেই মানুষগুলি লোপ পায়নি। বরং সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে।আমি আবিরের যত নাটক দেখেছি, তাতে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল গল্প। ওর নাটকে একটা সম্পূর্ণ গল্প থাকে। শুরু থেকে যা উত্তরণে পৌঁছায়।সঙ্গে থাকে চরিত্রের বিন্যাস।

ছোট হোক বা বড়, প্রতিটি চরিত্রসম্পূর্ণ হয়ে ফুটে ওঠে মঞ্চে। এই নাটকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।নাটকটির সময়সীমা ঘন্টা খানেকের মতো, কিন্তু অত‍্যন্ত যত্ন সহকারে নির্মিত। টানটান, মেদহীন। সেই সঙ্গে এক ঝাঁক আনকোরা অভিনেতার সাবলীল অভিনয়। সে প্রথমের দু’জন আদর্শহীন রাজনৈতিক চ‍্যালাই হোক বা মাতাল সেই লোকটি, যে শুধু বলে গেল ‘ডাগদার ভগবান হ‍্যায়’, অথবা থুড়থুড়ে বুড়িটি, যে ডাক্তারখানায় এসেছে শুধু একটি পরনের কাপড়ের আশায়। সকলেই দুর্দান্ত ও প্রাণবন্ত। মূল যে তিনটি চরিত্র- বাগী রাণী চরিত্রে শর্বরী মুখার্জি, ডাক্তারের চরিত্রে অভিজিৎ কুমার রায় ও মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চরিত্রে কৌশিক টুকাই চ্যাটার্জীর অভিনয় মনে দাগ কেটে যায়।এমনকি ছোট্ট একটি চরিত্র লছমন, বাগী রাণীর সহযোগী। মাঝেমাঝেই অলোকের রাখা স্কুটিটিকে তার দেখা, তার গায়ে হাত বোলানো, যেন একটা স্বপ্ন ছিল যা হারিয়ে গিয়েছে, খুব যত্ন করে মেলে ধরা হয়েছে নাটকে।খুব সুন্দর উপস্থাপনা। ঘটনার প্রবাহে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে নাটকটি। এক ঘন্টা সময় কোথা দিয়ে চলে যায় টের পাওয়া যায় না। নাটকের শেষে রয়েছে ভয়ঙ্কর এক চমক। মন বলে বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমনটাই হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নাগরিক বিবেক তাতে সায় দেয় না।


নাটক শেষ হয়ে যাবার পরও নাটকের রেশ থেকে যায়। ভাবতে বাধ্য করে ‘অপাঙক্তেয়’।মঞ্চ নির্মাণ বেশ ভালো। আবিরেরই পরিকল্পনা। মঞ্চে একটা আস্ত স্কুটি রাখা থাকে। তার রঙিন অবস্থান মঞ্চকে আকর্ষক করে তোলে। বাবলু সরকারের আলো খুব ভালো। বোঝা যায় নাটকটি তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে। গ্রাম‍্য এলাকার টিমটিমে আলোর বিষয়টি যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন মঞ্চে, তেমনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে আলোর রঙ ব্যবহারে দৃশ্যের মেজাজকে ধরেছেন নিপুণতার সঙ্গে। নাটকের আবহ তৈরি করেছেন কল্যাণ সরকার। মঞ্চ তৈরি করেছেন অজিত রায়, আবিরের ভাবনায়। মেক আপ করেছেন পিংকু সাহা।’নয়াবাদ তিতাস’কে ধন্যবাদ জানাই এমন মনোগ্রাহী ও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের মানুষকে সচেতন করতে প্রয়োজনীয় এমন একটি নাটক মঞ্চস্থ করবার জন্য। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮ ই জুন ২০২৫, তপন থিয়েটারে। সেদিন দেখেছিলাম, আবারও দেখলাম ২২ শে আগষ্ট ২০২৫, তপন থিয়েটারেই; ‘নয়াবাদ তিতাস’-এর নাট্য উৎসব – ‘ভরত রস ও ভাব উৎসব ২০২৫, পর্ব ২’ তে।

Related posts

Leave a Comment