পাকিস্তানে একটি গোটা ট্রেন অপহরণ করল বালুচিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী। জাফর এক্সপ্রেস নামের ওই ট্রেনটি বালুচিস্তানের কোয়েটা থেকে পেশোয়ারে যাওয়ার সময় ৩০ জন নিরাপত্তারক্ষীকে হত্যা করে অপহরণ করে বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। ট্রেনটিতে তখন প্রায় সাড়ে চারশো যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২১৪ জন নিরীহ যাত্রীকে পণবন্দি করে বালুচ বিদ্রোহীরা। তাদের আক্রমণে ট্রেনের একজন ফলে লোকো পাইলট আহত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বেলুচিস্তানের গুদালার ও পিরু কোনেরি এলাকার মধ্য দিয়ে ট্রেনটি যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। এতে ছয়জন সামরিক কর্মী নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হামলাকারীরা ট্রেনটিকে পাহাড়ি অঞ্চলে থামাতে বাধ্য করে, যেখানে যাত্রীদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।
মঙ্গলবার পাকিস্তানের অশান্ত বেলুচিস্তান প্রদেশে বিদ্রোহীরা প্রায় ৫০০ জনকে বহনকারী একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ছিনতাই করে। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি যে আক্রমণটি দাবি করেছে-বিদ্রোহীরা জাফর এক্সপ্রেসের উপর গুলি চালিয়েছে-বলেছে যে তারা ২১৪ জনকে জিম্মি করেছে, এবং ৩০ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মী নিহত হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটি নিরাপত্তা বাহিনী পিছু না সরলে সকল জিম্মিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল।
বিদ্রোহী বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে যে, তারা মাশকাফ, ধাদার, বোলানে একটি কৌশলগত অভিযান চালিয়ে জাফর এক্সপ্রেসকে লাইনচ্যুত করে নিয়ন্ত্রণ ও দখল করেছে। ঘটনার পরে একটি বিবৃতি জারি করে বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। সেই বিবৃতিতে বালুচিস্তান সরকারের মুখপাত্র শাহিদ রিন্দ জানিয়েছেন, ‘পেহরো কুনরি এবং গাদালারের মাঝামাঝি যাত্রিবাহী ট্রেনটি অপহরণ করেছে আমাদের স্বাধীনতাযোদ্ধারা। আমাদের বিশেষ ইউনিট মাজিদ ব্রিগেড, এসটিওএস ও ফাতেহ ব্রিগেড রয়েছে এই অপহরণের পেছনে।’
বেলুচিস্তান সরকার এই হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে, “কোয়েটা থেকে পেশোয়ার যাওয়ার পথে পেহরো কুনরি এবং গাদালারের মধ্যে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে তীব্র গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গিয়েছে।”
পাকিস্তান রেল দফতরের আধিকারিক মহম্মদ কাশিফ জানিয়েছেন, বোলানের মাশকফে ট্রেনটি আসতেই হামলা চালায় জঙ্গিরা। টানেল নং-৮এ ট্রেনটি থামার সময় ৯টি কোচবিশিষ্ট ট্রেনটিতে প্রায় ৫০০ জন যাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, যাত্রী ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে, রেল পুলিশ জানিয়েছে যে ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। যদিও প্রতিবেদনে একাধিক যাত্রী আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ প্রকৃত পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
জানা গিয়েছে, এদিন বোলানে ট্রেনটি পৌঁছলে স্বাধীনতাকামীরা রেলপথ উড়িয়ে দেন। যার জেরে ট্রেনটি থামাতে বাধ্য হয়। তারপরই ট্রেনের দখল নেয় জঙ্গিরা। শাহিদ রিন্দ দাবি করেছেন, ‘আপাতত পণবন্দিরা ভালো আছেন। পাক সরকার তাঁদের দাবি মেনে নিলেই বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘ট্রেনে উপস্থিত মহিলা, শিশু এবং বালুচ যাত্রীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কোনও আমজনতাকেই আটকে রাখা হয়নি। কেবল পাক সেনা, পুলিশ, সন্ত্রাসবিরোধী ফোর্স এবং আইএসআইয়ের আধিকারিকদেরই আটক করা হয়েছে।’
পাকিস্তান প্রশাসনকে হুমকি দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, পণবন্দিদের মুক্ত করার জন্য সরকার তরফে যদি কোনও সেনা অভিযান চালানো হয়, তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে। সেক্ষেত্রে সব পণবন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তার দায় পাকিস্তান সেনাকে নিতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশীয় রাজ্য কালাত ১৯৪৭ সালের ১১ অগস্ট ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। ১২ অগস্ট কালাতের শাসক মির সুলেমান দাউদ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু সেই স্বাধীনতার মেয়াদ ছিল ১৯৪৮-এর ২৭ মার্চ পর্যন্ত, প্রায় সাত মাস। বালুচিস্তানের মানুষের কাছে সেই দিনটা আজও যন্ত্রণার ‘পরাধীনতা দিবস’! সাত দশক আগে ওই দিনেই পাকিস্তানি সেনা দখল করে নিয়েছিল বালুচিস্তান। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তৎকালীন শাসককে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। বালুচিস্তানের পরবর্তী ইতিহাস ফের নতুন স্বাধীনতা যুদ্ধের।
পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বালুচিস্তান প্রাকৃতিক ভাবে সবচেয়ে সম্পদশালী। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে সেখানে বসবাসকারী বালুচ নাগরিকদের। বালুচের স্বাধীনতাকামী নেতা আবদুল কাদির বালুচ বছর কয়েক আগে দিল্লি এসে বলেছিলেন, তাঁরা চান ১৯৭১-এ ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবেই বালুচিস্তানের পাশে দাঁড়াক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে বালুচিস্তানের উপর পাক নিপীড়ন বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরব হওয়ার আবেদনও জানিয়েছিলেন তিনি। কারণ ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পরে গত কয়েক বছরে সেখানকার সম্পদ লুট আরও বেড়েছে। ওই রাস্তা ব্যবহার করেই ইসলমাবাদ এবং বেজিংয়ের শাসকেরা বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করছে বলে বালুচ ন্যাশনালিস্ট আর্মি (বিএনএ)-র মতো স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ।