মৃন্ময় ভট্টাচার্য
সম্পূর্ণ বেকার নির্বান্ধব জীবন। তীব্র দাবদাহের কারণে বাড়ির একটা শয়নকক্ষকে নিখিল বিশ্ব মনে করে, স্বেচ্ছা বন্দীত্বের মধ্যেও জীবন থেমে থাকছে না। চির শীতলতা প্রাপ্তির আগে কিছুটা শীতলতায় অভ্যস্ত হতে, ছাদ থেকে বাদুড়ের মতো ঝোলানো তিন পাখা বিশিষ্ট হাঁড়ি মুখো একটা ধাতব নিষ্প্রাণ বস্তু, জোরালো এসি (অল্টারনেটিভ কারেন্ট)-র শক্ পেয়ে যে এখন প্রাণবন্ত হতে বাধ্য হয়েছে। সেটি হ’ল আমার ফ্যান। তবে এই দাবদাহের কারণে সে আমার নয়, উল্টে আমিই তার এমন ফ্যান হয়ে পড়েছি যে, মনে হয় তাকে ছাড়া একদিনও আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
অসীম অবসরকে লাঘব করার জন্য দাগ কাটার অপচেষ্টায় কলম ধরেছি। বুঝি এই অগভীর আঁকা-বাঁকা দাগ একেবারে ভঙ্গুর, অস্থায়ী। তবু সময় কাটাতে রোজই একটু হাল্কা আঁচড় কাটতে ইচ্ছা জাগে। প্রখর রোদের আস্ফালন থেকে অব্যাহতি পেতে ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ করেছি। তাই দূরদৃষ্টির অভাবের কারণে আঁচড় কাটার বিষয় নিয়ে ধন্ধে পড়েছি। ছাদে ঝোলানো শক্ খেয়ে প্রাণবন্ত হওয়া ঐ হাঁড়িমুখোটাকেই বেছে নিচ্ছি আজকের বিষয় হিসাবে।
ফ্যান শব্দটি একটি সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ। পরিবেশ ও ভাবনা অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গরমকালে ঐ শব্দটি হাঁড়িমুখো পাখা বিশিষ্ট ঘূর্ণায়মান জীবনদায়ী বস্তু হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জনপ্রিয় অভিনেতা, অভিনেত্রী, খেলোয়াড়দের কাছে ফ্রি-তে গ্যাস দিয়ে উর্ধ্বে ওঠানো কিছু বিগলিত প্রাণ বোঝায়। রান্নাঘরে ঐ একই শব্দ ফুটন্ত ভাতের গলন্ত নির্যাসকে চিহ্নিত করে। আবার ফ্যানের পিছে “টাস্টিক” যোগ করলে দারুণ হয়ে যায়।
আমার কোনও বিশেষ দক্ষতা না থাকায় ঐ হাঁড়ি মুখোই আমার একমাত্র ফ্যান। যদিও ফ্যানটায় একটা স্টিক আছে। তবুও ফ্যানটাকে ফ্যানটাস্টিক কখনোই মনে হয় না।
তবে হ্যাঁ, এককালে আমার আরও একটি ফ্যান ছিল। এখন যিনি আমার অর্ধেক অঙ্গ হানির জন্য দায়ী। মানে আমার অর্ধাঙ্গিনী যখন পূর্ণাঙ্গিনী ছিলেন। কিছুকালের জন্য তিনি আমার ফ্যান হয়ে উঠেছিলেন। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত আমার মধ্যে যে কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা গুণ আছে, তা কাউকে বলতে শুনিনি। আমি ও আমার মা-বাবাও তন্ন তন্ন করে তা আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু সেই প্রাক্তন কিশোরীর ছিল এক আণুবীক্ষনিক দৃষ্টি। আমার মধ্যেও যে কত গুণ আছে তার সাথে আলাপের পরই আমি জানতে পেরেছিলাম। তবে নিজের হঠাৎ পাওয়া এই ঢাক নিজে পেটানো সত্ত্বেও সে ছাড়া আর কেউই আমার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি মানতে রাজি হয় নি।
আবেগে বিগলিত হয়ে যখন হাস্যমুখে নিজ অঙ্গহানি করে তাকে অর্ধাঙ্গিনী করলাম। চির পরাধীনতার বন্ধনে তাকে ও নিজেকে জড়ালাম, অনভ্যস্ত হাতে গৃহকর্ম করতে সে বাধ্য হ’ল। গরম ভাতের ফ্যান গাললে যেমন ফ্যানের সাথে ভাতের অনেক খাদ্যগুণ বেরিয়ে যায়, তেমনি তার দ্বারা আবিষ্কৃত আমার সকল গুণগুলো উধাও হয়ে গেল একে একে। সব গুণ অন্তর্হিত হওয়ার ফলে এখন আমি এক গৃহপালিত স্বামীতে পরিণত হয়েছি। অপেক্ষায় আছি আসামীর তকমা পেতে।
previous post
next post