মৃন্ময় ভট্টাচার্য
গত দু-তিন দিন ধরে খবরের কাগজে, টিভির খবরে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখছি, পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের খবর। সব বড় বড় শহর জ্বলছে দাউদাউ করে। শত্রু দেশে বিপর্যয় হলে, মুখে দুঃখ প্রকাশ করলেও, মনের মধ্যে কিন্তু ফল্গু নদীর মতো আনন্দের চোরাস্রোত বয়ে চলেছে। তা বেশ বুঝতে পারছি। বেশ হয়েছে, ভাল হয়েছে! এবার বোঝো ভারতে জঙ্গি পাঠিয়ে নিরীহ মানুষ মারার ফল!
নিজ গৃহে সকালের পরিবেশ ছিল বেশ মনোরম। পুত্র পড়াশোনায় ব্যস্ত। গৃহিনী রান্নাঘরে। আমি খবরের কাগজের পাতায় শান্ত মনে অশান্তির খবরগুলো গোগ্রাসে গিলছি। খুন, জখম, ধর্ষণ, কয়লা চুরি, গরু পাচার, অর্থের বিনিময়ে চাকরি এতেই রোজ কাগজের পাতা ভরে যায়। পড়তে খারাপ লাগে, তবু পড়ি। তবে এখন উপরি পাওনা হিসাবে প্রতিবেশী শত্রু দেশের গৃহযুদ্ধের খবরটা মনকে বেশ তৃপ্তি দিচ্ছে।
সকালে চা, বিস্কুট খাওয়ার পর এসেছে দুটো রুটি ও আলুর তরকারি। প্রাতরাশ মানে ব্রেকফাস্ট, রাত্রি সাড়ে দশটায় খাওয়ার পর যে অনশন করেছিলাম তার সমাপ্তি ঘোষণা করতে চলেছে। ঠিক তখনই বেজে উঠলো কলিং বেল!
কে এলো এই সময়? গৃহকর্ত্রী বললেন “হুদো এসেছে, তোমার ঘরটা একটু পরিষ্কার করবে।” কথাটা শুনেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। গৃহ যুদ্ধের আগুন। খবরদার, আমার ঘরে কেউ কোনও জিনিসে হাত দেবে না!
বাড়ির বাইরের দিকে একটা ঘর আমার কর্মশালা। দু-দিন আগে আমার শালা এসেছিল বাড়িতে। সে ওই ঘরে একবার ঢুকেছিল। ও শালা নিশ্চয়ই তার দিদির কানে কোনও বিষ ঢেলেছে। না হলে হঠাৎ আমার দরকারি জিনিসে ঠাসা ঘর পরিষ্কার করার বাই উঠবে কেন!
কি নেই আমার ঐ ব্যক্তিগত ঘরটিতে! খুঁজলে আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সবই পাওয়া যাবে। আমার সাহিত্য সৃষ্টির নানা ধরণের রসদ, দিস্তা দিস্তা দরকারি কাগজ। বিজ্ঞান গবেষণার কাজে লাগা স্ক্রুডাইভার, হাতুড়ি, প্লায়ার্স, ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ওয়াই-ফাই রাউটার সহ নানাবিধ সামগ্রী। ওই ঘর পরিপাটি করে সাজানোটা যে অন্যায়, সেটা এদের মতো সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়। তাই দুই বিপরীত ভাবনার মানুষের সহাবস্থানে লেগে গেল গৃহযুদ্ধ। আমি কিছুতেই আমার কর্মশালাকে বাড়ির বৈঠকখানা বানাতে দিতে রাজি নয়। মহাপুরুষদের ঘর অগোছালো না হলে মানায়? আমার অনেক দুঃখের মধ্যে একটা দুঃখ যে, আমার কাছের মানুষেরা আমাকে একটুও চিনতে পারল না। আমার মধ্যে যে মহাপুরুষের সকল লক্ষণ বিদ্যমান, আমি ছাড়া আর কেউ তা বুঝতে চাইছে না। হয়তো মরে যাওয়ার পর বুঝবে। তবে তাতে তো আমার কোনও লাভ হবে না!
গৃহিনী কাকুতি মিনতি করে যতবার আমাকে বোঝাতে যাচ্ছে, ততবারই আমার মাথার আগুন উস্কে উঠছে। কঠিন কঠিন শব্দবাণে বিদ্ধ করে নিজের প্রবল তেজ প্রদর্শন করে চলেছি। যাতে ভয় পেয়ে হুদোও পালাতে বাধ্য হয়। নারীশক্তি বলে একটা শব্দ আছে। সেটা খেয়ালে ছিল না। পার্বতীও যে দুর্গা রূপিনী হতে পারে তা পড়েছিলাম পৌরাণিক ধর্ম গ্রন্থে। আজ গৃহযুদ্ধের মাঝে সেই অসুরদলনী দেবীর দর্শন পেলাম স্বচক্ষে। হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন অসুর অসুর লাগতে শুরু করল। জ্বলন্ত মাথায় কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন বরফ গলা জল ঢেলে দিল। আমি তো পাকিস্তানিদের মতো কট্টর গোঁয়ার গোবিন্দ নয়! বুঝলাম আমার ঐ কর্মশালা হাতছাড়া হবেই। বেশী তেজ দেখালে পেটে টান পড়বে। কারণ গৃহের পাকস্থলিটা ( যেখানে কাঁচা খাদ্যকে পাকানো হয় ) ত্রিশুল ধারিনী কটমটে চক্ষু বিশিষ্ট দেবীর নিয়ন্ত্রণে। তাই রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলাম। পাকিস্তানিদের যদি আমার মতো বুদ্ধি থাকতো তাহলে এই সময় ভারতের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে নিত। তাতে এইরকম খাদ্য সঙ্কটে পড়তে হতো না।
যাই হোক, গৃহিনীর ভয়ে গৃহকর্তার পরাজয়ে আপনারা যদি ছিঃ ছিঃ করেন, আমি কানে তালা লাগিয়ে নেব। তাই বলে আপাতত যুদ্ধ জয়ী হয়ে পেটে তালা ঝোলানো সম্ভব নয়। পেট বাঁচলে তবেই তো আমার সাহিত্যচর্চা, গবেষণা ও প্রাণটা আরও কিছুদিন বাঁচার সুযোগ পাবে।
দুপুরে মুখের সেই গর্জন, কর্মব্যস্ততা ও কর্মশালা ভুলে নতুন বৈঠকখানার সোফায় দিব্যি নাসিকা গর্জন করে সুখের স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।
previous post