মৃন্ময় ভট্টাচার্য
তখন ক্লাস এইটে পড়ি, টিফিন হওয়ার আগে হতো চারটে ক্লাস, টিফিনের পর ছুটির আগে আরও দুটো। শনিবার টিফিনের বালাই নেই, চার ক্লাস হলেই ছুটি।
আমাদের স্কুলের হেড মাষ্টারমশাই ছিলেন মানব বাবু, মানবেন্দ্র নাথ পাল। তাঁর উচ্চতা খুব একটা বেশি ছিল না, ছোটোখাটো সামান্য মেদ বিশিষ্ট দেহ, পরনে ধুতি ও পাঞ্জাবী্ পায়ে একজোড়া সাধারণ চটি, পাঞ্জাবীর পকেটে একটা নস্যির কৌটো।
হেডস্যার ছাত্রদের খুব একটা বকতেন না, মারতেনও না। তবু তাঁকে আমরা সবাই ভীষণ ভয় পেতাম, শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়। শ্রদ্ধার পরিমাণ অবশ্যই ভয় অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি ছিলো, এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাই তিনি আমাদের কাছে শুধুমাত্র মানব পাল ছিলেন না, ছিলেন পাল পাল মানবের মধ্যে এক মহামানব এবং এখনো তাইই আছেন, থাকবেনও চিরকাল ।
ওনার পড়ানো ও পড়া ধরার টেকনিকও ছিল অনন্য। পড়াতেন ইতিহাস, ক্লাস এইটে সপ্তাহে দুদিন তাঁর ক্লাস থাকতো। ক্লাসে ঢুকেই ছেলেদের মুখ দেখে বুঝে যেতেন কোন কোন ছেলে আগের দিনে দেওয়া পড়া না তৈরি করে সেদিন ক্লাসে এসেছে।
প্রথমেই পড়া জিজ্ঞাসা করতেন তাদের মধ্যে একজনকে, ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে মাথা চুলকাচ্ছে। স্যার বললেন ” আপনি কি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছেন, নতুন বৌয়ের মতো মুখ নিচু করে রয়েছেন কেন ? মুখটা একটু তুলুন, আমার দিকে একটু তাকান “। ছেলেটি মুখ তুললো অতি কষ্টে । স্যার বললেন “আগের দিনের পড়াটা করে এসেছেন তো “। ছেলেটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। “তাহলে দয়াকরে আমাকে বলুন “। ছেলেটা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। “ও আপনি আমাকে পড়া বলবেন না, তাই তো?
বুঝতে পেরেছি আপনি সশব্দে পড়া বললে সব বন্ধুরা পড়া শুনে ফেলবে, তাই বলতে চাইছেন না, বলুন আপনাকে কি দিলে আপনি খুশি হয়ে পড়াটা বলবেন?” ছেলেটি অসহায় ভাবে দু’হাত কচলাতে শুরু করেছে। স্যার হঠাৎ পকেট থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করেছেন। ” এই টাকাটা আপনাকে দিলে নিশ্চই পড়া বলবেন, তাও বলবেন না?”
এর থেকে স্যার যদি বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে দিতেন বা নীলডাউন বা গালে কষিয়ে দুটো চড় মারতেন, শাস্তি অনেক কম মনে হতো। কিন্তু হেড স্যারের কাছে এই চূড়ান্ত অম্লমধুর শাস্তির ভয়ে আমরা ওর পড়া না করে স্কুলে যেতে সাহস পেতাম না।
চলবে…….
