অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।
তখনকার দিনে তেহট্ট যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না তেহট্ট যাওয়ার। এখন গাড়ি ঘোড়া ছুটিয়ে সব হাতের মুঠোয়। হোগলবেড়িয়া থেকে কিশোরী নাতনিকে নিয়ে তার ঠাকুমা রাধাকিশোরী দেবী হট্টমেলা দেখতে তেহট্টে তেমাথায় নেমে লোকের সঙ্গে এই সংস্কৃতি মেলায় চলে এসেছেন। সামনে বোর্ড দেখে বললেন, হ্যাঁরে কিশোরী কি লেখা আছে এখানে? কিশোরী বলল, ঠাকুমা তুমি ইংরেজি জানো না, তাই বাংলায় বলছি- লাল কাটা ঘর! ঠাকুরমা বললেন লাল কাটলেই হলো? ঢুকি তারপরে দেখি কে লাল কাটবে? ঘরে ঢুকেই ঠাকুরমা বললেন, বাবা হট্টমেলায় এসেছিলাম বিশ্বরূপ দর্শন করতে। কিন্তু সবার সাথে পা মিলিয়ে ভুল করে এখানে চলে এসেছি। একজন বললেন, ঠিক আছে এসেই যখন পড়েছেন, তখন এখানে কিছুক্ষণ থেকে তারপর তেমাথার মোড়ে হট্টমেলায় যাবেন।
এদিকে মাইকে বলা হচ্ছে, হট্টগোল করবেন না, সভা এখনই শুরু হবে। বুড়িমা বলছেন, মাইকে কে বলছে গো ওই ছেলেটি। একজন বললেন, উনি অপূর্ব! ঠাকুমা এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা তুমি অপূর্ব, সাক্ষাৎ কৃষ্ণ! তা বাবা তোমার সারথিরা কোথায়? ওই যে সঞ্জয়, উনি রথে চেপে ঘুরে ঘুরে এর প্রচার করছেন। উনি এর রূপকার। খাওয়া দাওয়া ভুলে তিনি এমাথা থেকে সেমাথা চরকির মতো ঘুরছেন। এই যে ইনি ফজলুর রহমান, মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ, সাক্ষাৎ ভগবান! আর এই যে মেঘনাথ। বুড়িমা বললেন- আরে বাবা! স্বয়ং ইন্দ্রের সভায় চলে এসেছি। হে বাবা মেঘনাথ! শুরু করো। এবার বুড়িমা বললেন, চৈতন্য দেখছি না। অপূর্ববাবু বললেন, চৈতন্য তো পুরীতে বিলীন হয়ে গেছেন!
বুড়িমা- না গো বাবা তা নয়। আমি বলছি, কারও মাথায় টিকি দেখছি না। যদি মাথায় চৈতন্য না থাকে, তাহলে সে মানুষ শুদ্ধ নয়। আমি তাই যার তার হাতে খাইনা। মেঘনাথ বললেন, ঠাকুরমা এখানে খাবার নেই। শুধু একটু চা খেয়ে ঠাণ্ডা হোন। বুড়িমাকে চা দেওয়া হল। বুড়িমা ভাবলেন, ঠাণ্ডা হতে বললেন যখন, তখন খেয়েই নিই। যেমন গেলা, অমনি মুখ পুড়ে গিয়ে চিৎকার! আমার সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করছো? গরমে ঠাণ্ডার নাম করে এ কি সব? একজন বললেন, এটা চা! বুড়িমা বললেন, চা নেশার জিনিস। আমার বংশে এসব কেউ দেখেনি বা খাইনি। আজ আমার জাত গেল গো নেশা খেয়ে! রাধামাধব! রাধামাধব! রাধামাধব! আজ বাড়ি গিয়ে গোবর খেতে হবে গা! অপূর্ব বুঝিয়ে বললেন, আপনি তো ঢোক গিলেন নি? তাহলে মুখ ধুয়ে নিন ঠিক হয়ে যাবে। আপনাকে আর কিছুই দেওয়া হবে না। ওই দেখুন, মিঠুন আপনার জন্য জল নিয়ে আসছে মুখ ধুয়ে নিন। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এই সেই মিঠুন, যে কিশোরকুমারের বৌ যোগিতাবালীকে বিয়ে করেছে? ওর হাতে জল, কখনোই না! মরে গেলেও ওর ছোঁয়া জল পান করব না।
অপূর্ব বললেন, তাহলে এই যে তাপস চক্রবর্তী আপনাকে জল দেবেন। ঠাকুরমা-বাবা তাপস! তুমি তো বাবা বামুনের ছেলে! পৈতে হয়েছে তো? ঘরে তাপসী আছে তো? গুরুকরণ করে গুরুমন্ত্র পাঠ করো তো? তাপস বললেন- ঠাকুমা, আমাকে কে মেয়ে দেবে? কি খাওয়াব? নিজের ভাতে বেগুন পোড়া শঙ্করাকে ডাক্। ঠাকুরমা বললেন- বাবা বৈষ্ণবের বোষ্টুমী থাকে, আর বামুনের বামনী থাকবে না তাই হয়? তোমার জন্য কোনও এক অবলা মেয়ে অপেক্ষা করে আছে। তুমি সেখানে ঝুলে পড়ো বাবা! নয়তো আমার নাতনি আছে, তাকে নাও। তাহলে নিজের ভাতে বেগুন পোড়া ভাগ করে খাবে। সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়। ভেবে দেখো, এই বুড়ির কথা।
এবার ধারাভাষ্য দিতে মাইক্রোফোন তুলে নিলেন তাপস চক্রবর্তী। মেঘনাথ বাহাদুর তিনি ক্যামেরা নিয়ে অনুষ্ঠানের ছবি তুলছেন! মাইকে অমায়িকভাবে বলে চলেছেন তাপস চক্রবর্তী। অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে, ধারাপাত উল্টে জয়বাবুর সঙ্গীত দিয়ে। জয়বাবু জোয়াল ঘাড়ে নিয়ে গান ধরলেন হা হা হা হা হা হা করে। কথা নেই শুধু আ আ হা হা। বুড়িমা বললেন- বাবা জয়! ঘাড়ের জোয়াল নামিয়ে হাল্কা হয়ে গান করো দেখি, একটা পদাবলী কীর্তন। এই নদীয়া একদিন ভেসে গেছিল কীর্তনে! আর আজ শুধু জগাই মাধাই? আবার বলে কি – যদি জগাই মাধাই না থাকিত, তবে নিমাইকে কি চিনতো লোকে? আরে তোদের মদ না হলে চলেনা বলেই তোদের নাম মদনা। বাবা বিশ্বরূপ পথ দেখাও বাবা! তোমার মুখদর্শন করে তোমার শ্রীচরণে গড়াগড়ি দিয়ে ফিরে যাব। চল্ রে, বলে নাতনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হট্টমেলায়। এদিকে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে একদৃষ্টিতে নাতনীর দিকে চেয়ে থাকেন তাপস চক্রবর্তী। ভুলে গেছেন পরবর্তী ঘোষণা। তুমুল হাততালিতে ঘোষকের চেতনা ফিরে এলো।