অভিজিৎ হাজরা, হাওড়া: গঙ্গা জলেই গঙ্গা পূজা হয়। গঙ্গা জল ছাড়া যেমন গঙ্গা পূজা ও অন্যান্য পূজা হয় না, তেমনই রবীন্দ্র -নজরুল-এর সৃষ্ট কবিতা, গান, আলোচনার মাধ্যমে পালিত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩ তম ও কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্ম জয়ন্তী।
গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার আমতা ১ নং ব্লকের রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত রসপুর গ্ৰামে ‘রসপুর পিপলস লাইব্রেরী’-র উদ্যোগে লাইব্রেরীর দ্বিতলে অডিটোরিয়াম কক্ষে পালিত হল রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ রবীন্দ্র-নজরুল-এর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন। লাইব্রেরীর সম্পাদক অসীম কুমার মিত্র স্বাগত বক্তব্যে আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমরা লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে মনীষীদের জম্ম দিন, রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের ঐতিহাসিক দিন, বিভিন্ন সমাজসেবা, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে চলেছি। দুঃখের বিষয় এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলিতে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক -অভিভাবিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, যুব সমাজের উপস্থিতি অত্যন্ত নগণ্য হয়। পাশাপাশি, যখন বিভিন্ন ক্লাব, পূজা কমিটি বিভিন্ন অপসংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান করে থাকে, ডিজে মাইক ব্যবহার করে, সেখানে মানুষকে জায়গা দিতে পারে না অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। যে অনুষ্ঠানে শুধু অপসংস্কৃতি পরিবেশিত হয়। এটা আমাদের খুবই ব্যথিত করে।”
রবীন্দ্র -নজরুল জয়ন্তী পালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমতা থানার অফিসার ইনচার্জ অজয় সিং, রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জয়ন্ত পল্ল্যে, রসপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতি-র সম্পাদক জলধর বাগ, সমাজকর্মী মুস্তাক আলি মন্ডল।
আমতা থানার অফিসার ইন চার্জ অজয় সিং একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে প্রাণের তাগিদে ছুটে যান। আজকেও তিনি প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততার মাঝেও প্রাণের তাগিদে ছুটে আসেন এবং সমগ্ৰ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজের সাহিত্য কীর্তির মাধ্যমে আজও তিনি সকলের মাঝে জীবিত, তাঁর সৃষ্টি অমর। তাঁর এই নাম যশের পিছনে ছিল তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ‘। তিনি আরও বলেন, ‘সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই, যেখানে তাঁর হাতের শৈপ্লিক স্পর্শ পড়েনি। তাঁর অমর সৃষ্টিগুলি রচনা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। তাঁর ছোঁয়ায় বাংলার সাহিত্য ভান্ডার হয়েছে পরিপূর্ণ। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্ৰণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীত স্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাই তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বলে মনে করা হয়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি জগতের মানুষের মনে নতুন চেতনার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। মানুষ শিক্ষা লাভ করে তাঁর অমর সৃষ্টিগুলি থেকে। তাঁর বাণী ও উক্তিগুলি মানুষের বাস্তবিক জীবনকে আজও পরিচালিত করে ‘।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে অদয় সিং বলেন, ‘সামর্থ, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ। কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা, গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে ‘। অজয় সিং, অসীম কুমার মিত্র-র ক্ষোভ প্রকাশ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উপস্থিতি নগণ্য হলেও দুঃখ করার কিছুই নেই। আজকে যাঁরা উপস্থিত হয়েছেন, এঁরাও যদি রবীন্দ্র-নজরুলের জীবনী, তাঁদের আদর্শ পথ চলার মন্ত্র করে , তাহলে সমাজের অনেক পরিবর্তন হবে ‘। তিনি এও বলেন, ‘আজকে গ্ৰামে গ্ৰামে ,পাড়ায় পাড়ায় যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ডিজে-র মাধ্যমে হয়, তা সমাজের প্রভূত ক্ষতি সাধন করছে। হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি করছে। সুহৃদ মানুষকে অসুস্থ করে তুলছে। কারণ, এই সব অনুষ্ঠানগুলিতে অপসংস্কৃতির জোয়ার বয়। এই অপসংস্কৃতির জোয়ারে বর্তমান যুব সমাজ গা ভাসিয়ে দেওয়ায় সমাজের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানগুলি থেকে মানুষ শিক্ষামূলক কিছুই পায় না। এই অপসংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানগুলি থেকে মানুষকে বিরত থাকতে হবে’। তিনি লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষকে বলেন, এই ধরনের মনীষীদের জীবনী মূল্যায়ণমূলক অনুষ্ঠান, জম্মদিন, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বেশি বেশি করে করতে হবে। আজকের শিশু, যুব সমাজ বর্তমান ও ভবিষ্যতের দেশ গঠনের কারিগর হবে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
জলধর বাগ বলেন, আজকের প্রজন্ম অপসংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসানোর জন্য তাঁরা দায়ী নয়। দায়ী তাদের অভিভাবক -অভিভাবিকা, শিক্ষক -শিক্ষিকারা। কারণ তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মনীষীদের জীবনী মূল্যায়ণ করা হয় না। তিনি প্রচার মাধ্যমকে দায়ী করে বলেন, আজকের দিনে টিভিতে যে সমস্ত অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়, তা অপসংস্কৃতির নামান্তর।
সমাজকর্মী মুস্তাক আলি মন্ডল বলেন, যুগ যুগ ধরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের রচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজ জীবনে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছাড়া আমাদের সংসার জীবন অচল। প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সারা দিন-রাত রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বর্তমান জীবনে আমাদের শিশু থেকে কিশোর-কিশোরী, কিশোর-কিশোরী থেকে যুবক-যুবতীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম সহ অন্যান্য মনীষীদের জীবনী, সৃষ্টি, কাজ, তাঁদের অবদান, তাঁদের আত্নবলিদানের মূল্যায়ণ নিয়ে বেশি বেশি করে বলার প্রয়োজন। রবীন্দ্র-নজরুল ও অন্যান্য মনীষীদের জীবন ধারায় চলার পথ প্রশস্ত করার জন্য এই ধরণের অনুষ্ঠান বেশি বেশি করে করতে হবে। রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জয়ন্ত পল্ল্যে বলেন, আজকের প্রজন্ম মনিষীদের ভুলতে বসেছে। তাঁরা মনীষীদের জীবনী, কাজ, আত্মত্যাগ, আত্ম বলিদান প্রসঙ্গে বেশি বেশি করে অনুষ্ঠান করে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তিনি এও বলেন, এই ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য প্রয়োজনে রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েত সর্বত্র সহযোগিতা করবে ‘।
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন পর্ণা সাহা, ঈশিতা রায়। নৃত্য পরিবেশন করেন তৃষা দাস। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনুপম মন্ডল, আফ্রিনা খান, সানিয়া খাতুন, রকিব খান।
রবীন্দ্র -নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমতা থানার অফিসার ইনচার্জ অজয় সিং-এর উপস্থিতি ও প্রাঞ্জল বক্তব্যে জম্ম জয়ন্তী উৎসব প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমাজকর্মী অতনু মন্ডল।