মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বলতে কী বোঝায়?
সব ওষুধেরই এক্সপায়ারি ডেট থাকে। এক্সপায়ারি ডেট হল একটা নির্দিষ্ট সময়। একটা ওষুধের কার্যকরী থাকার সময়। ওষুধের কাজ হল, রোগ সারানো। তবে ওষুধ তো কোনও ম্যাজিক নয়। কতকগুলো উপাদান দিয়ে তৈরি হয় ওষুধ। ওষুধের সেই ‘কম্পোজিশন’গুলি কতদিন ঠিক থাকে, তা নির্ধারণ করে দেয় এক্সপায়রি ডেট। এরপর ওই ওষুধ খারাপ হয়ে যায় বলেই আমরা ধরে নিই।
একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক প্যারাসিটামল ৫০০। ওষুধের গায়ে ৫০০ লেখা আছে বলে এই ওষুধে কিন্তু ৫০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল থাকে না। ওষুধে ৪৯০ থেকে ৫১০ মিলিগ্রামের মধ্যে প্যারাসিটামল থাকবে। এখন সিরাপ হলে এর মধ্যে রঙ, গন্ধও মেশানো হয়। আবার ট্যাবলেট হলে শক্ত করার জন্য আঠা মিশিয়ে উচ্চ চাপে ট্যাবলেট তৈরি হয়। তাছাড়া ওষুধ মানেই তার মধ্যে রাসায়নিক, ফিজিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল গুণ থাকবে। যেহেতু ওষুধে নানাবিধ রাসায়নিক দ্রব্য থাকে, সেহেতু একটা সময়ের পর দেখা যায় ওই ওষুধের টক্সিক প্রভাব অর্থাৎ বিষগুণ বাড়তে থাকে। সেই কারণেই ওষুধের গায়ে কতদিনের মধ্যে ওষুধ খেতে হবে তা লেখা থাকে।
সব ওষুধ কার্যকরী থাকার দিন কি একই?
একটা ওষুধ কতদিন কার্যকরী থাকবে তা আসলে একটা অঙ্কের মতো। সেই হিসেব করে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন লেখা হয় ওষুধের প্যাকেটের গায়ে। তার সঙ্গে থাকে সাবধানবাণী— ওই দিনগুলির পেরিয়ে যাওয়ার পর ওই ওষুধ খেলে ক্ষতি হতে পারে। তবে, হতেই পারে ওষুধটির গুণগত মান তখনও ভালো রয়েছে। তবে যা যাচাই করার মতো পরিকাঠামো তো আর সাধারণ মানুষের কাছে নেই। তাই মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
ইঞ্জেকশন এবং ট্যাবলেট, দুটি ক্ষেত্রেই কি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে?
ধরা যাক আপনার মাথায় ব্যথা। আপনি ওষুধ খাচ্ছেন। এই ওষুধ রক্তের সঙ্গে মিশে ওই ব্যথার জায়গায় গিয়ে কাজ করে। আবার ইঞ্জেকশন নিলেও একই ব্যাপার ঘটে। অতএব, এক্সটারনাল হোক বা ইন্টারনাল— একবার ওষুধের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে আর তা কোনওভাবেই ব্যবহার করা উচিত নয়। বিশেষ করে ইন্টারনাল মেডিসিন অর্থাৎ রক্তের সঙ্গে সরাসরি যে ওষুধগুলি মেশে, সেগুলির মেয়াদ ফুরানোর পর ব্যবহার ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এক্সটারনাল মেডিসিন বা ট্যাবলেট, মলমের ক্ষেত্রেও মেয়াদ ফুরালে ব্যবহার করা উচিত নয়। রোগীর গায়ে র্যাশ বেরতে পারে। অন্যান্য উপসর্গও দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
কোন ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
তা হবে। তবে শরীরে কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তা নির্ভর বেশ কিছু বিষয়ের উপর। যেমন খাওয়ার আগে হলে একরকম, খাওয়ার পরে হলে অন্যরকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এছাড়া কোন ওষুধ খাওয়া হচ্ছে, তার উপরও সাইড এফেক্ট নির্ভর করে। এক্সপায়ারি ডেটের পর কেমিক্যাল উপাদানগুলি নানাবধি বিক্রিয়ায় অন্য উপাদান তৈরি করে। ফলে ভুল করে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেলে র্যাশ বেরনো ছাড়াও অন্ধ, বধির হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না! কিডনি, হার্টেরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকী, রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। মনে রাখবেন, পৃথিবীতে এমন কোনও ড্রাগ নেই, যার কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রত্যেক ওষুধেরই ভালো গুণ, খারাপ গুণ রয়েছে। দেখতে হবে ওষুধের ভালো গুণটা কার্যকর থাকছে কি না।
সাধারণ রোগ যেমন জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, পেটব্যথার মতো ঘটনায় এমন ওষুধ খেলেও কি ভীষণ ক্ষতি?
আমি তো বলব এসব ক্ষেত্রেও ওরকম ওষুধ একটা খেয়ে ফেললেও অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। কারণ ওষুধ কোন জায়গায়, কতদিন ধরে পড়েছিল সেই বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
শুকনো এবং ঠান্ডা জায়গায় ওষুধ রাখতে বলা হয় কেন?
বিভিন্ন ওষুধ রাখার নিয়ম আলাদা। ওষুধের গায়ে সেকথা লেখা থাকে। নিয়ম অনুযায়ী উপযুক্ত পরিবেশে ওষুধ রাখলে তার কার্যকারিতা বজায় থাকে দীর্ঘদিন।
ওষুধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তো কার্যকারিতা কমে? তাহলে ক্ষতি হবে কেন?
বুঝেছি। আপনি বলতে চাইছেন, কোনও একটি ওষুধ, যেমন প্যারাসিটামল ৫০০ এর ক্ষমতা কমে ১০০ হলে ক্ষতি কি? ১০০ পর্যন্ত যেতে হবে না। ধরা যাক পাওয়ার কমে ৪৮০ হল। কিন্তু তাতে তো রোগীর সমস্যা কমবে না! এখানেই শেষ নয়। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ওষুধের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রায়নিকগুলির বিক্রিয়ায় টক্সিক উপাদান বেড়ে যায়। সেটা কিন্তু মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেলে তা ভালো হওয়ার তুলনায় খারাপ করার প্রবণতা বাড়বে। তাই আমাদের সেটা খাওয়া উচিত নয়।
বাচ্চাদের সাসপেনশনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দু’টো বোতল কিনলে তবেই পাঁচ দিন বা ছয় দিন যাবে। সেক্ষেত্রে পাঁচ বা ছয় দিনের ডোজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে বাড়তি ওষুধ কি ফেলে দেব ?
পিঠোপিঠিতে কারও একই রোগ হলে তবুও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তাও বলব একবার বোতল খুললে, সেটা পুনরায় ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ায় ভালো। কারণ সিলড বোতল এক্সপায়রি ডেট পেরনোর আগে পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। কিন্তু খোলা বোতলে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে যায় আগেই। সমস্যাটা হল, এগুলি ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার জাগলারি। এগুলোর বাইরে বিভিন্ন সমীক্ষাতেও দেখা গিয়েছে, বাড়িতে সিল খোলা ওষুধ থাকা উচিত নয়। এর ফলে ওষুধের অপব্যবহার হয়।
সিল করা ভাঙা ট্যাবলেট কি মেয়াদ উত্তীর্ণ বলে গণ্য হবে?
ট্যাবলেট ভাঙে নানা কারণে। ওষুধ বানানোর প্রক্রিয়াতে পার্থক্য থাকে। গুণের তফাৎ থাকে। তাই কখনও ওষুধ ভেঙে যায়। আমার পরামর্শ হল, ওষুধ গুঁড়ো হয়ে গেলে, রঙ পাল্টে গেলে, কোনওরকম সন্দেহ হলে সেই ওষুধ ব্যবহার করবেন না। পাল্টে নিন। এমনকী প্যাকেটের প্রথম ট্যাবলেট খুলতেই ভাঙা বেরলে দোকানে গিয়ে পাল্টে নেওয়াই ভালো।
বেশ কিছু বিদেশি চিকিৎসকরা বলছেন, সবে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেলে খুব একটা ক্ষতি নেই?
মানুষ কোন কথায় বিশ্বাস করবেন আর কোন কথায় করবেন না, তা মানুষের উপরই নির্ভর করে। কারণ ইন্টারনেটে নানাবিধ তথ্য মেলে। আমেরিকা কিন্তু এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া। মুশকিল হল ইউরোপের দেশ অনেক উন্নত হলেও, নীতির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। তবে আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়া অপরাধ। তাতে ক্ষতি হতে পারে। অতএব মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খাব না। কাউকে খেতেও উৎসাহিত করব না।
previous post
next post