মৃন্ময় ভট্টাচার্য
ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে, ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা এই গভীর ঘুমের কল্যাণে এখন ঝরঝরে লাগছে। এখুনি তৈরী হতে হবে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে। সবাই উঠে পরেছে, কিন্তু রবিদাকে তো দেখছি না! গেল কোথায়?
খোঁজ নিতে গেলাম ভোলার কাছে, না এ ভোলা আমাদের ভোলা নয়, হোটেলের বয়, স্বভাবে আমাদের ভোলার ঠিক বিপরীত। পড়াশোনা করেনি, সবকিছু ভুলে যায় বলেই কি ওর নাম ভোলা, তা আমার জানা নেই। কোনো কিছুই মনে রাখতে চায় না, কারণ ওর মহার্ঘ স্মৃতি ভান্ডার আমাদের মতো অতি সাধারণ খদ্দেরদের জাগতিক সুখ সুবিধা দেখার কাজে ব্যায় করা সঙ্গত মনে করে না। তবু রবিদা যে আধ ঘন্টার ওপর বাথরুম দখল করে বসে আছে, সেটা তার অজানা নয়।
মধ্যাহ্ন আহারের পর থেকেই রবিদার নাকি বিছানার বদলে বারেবারে ঐ বাথরুমের সান্নিধ্য সুখের বলে অনুভূত হচ্ছে। হবে নাই বা কেন! গতরাতে যে মুরগিটার রবিদার দ্বারা মুন্ডুপাত হয়েছিল, সে রবিদার পেটে গিয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বালাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
ওদিকে ঐতিহ্য দর্শনে এখুনিই বের হওয়া উচিত, কারণ দেরি করলে আকাশের রবি অস্তাচলে চলে যাবেন, ফলে পলাশীর মতো এখানেও অন্ধকারে আমাদের অভিযান মাঠে মারা যাবে। আমাদের রবিদা এখন বাথরুমে জলাঞ্জলি দিতে ব্যস্ত, প্রদীপ দরজার বাইরে থেকে ডাকতেই, করুণ কন্ঠে “আমি যেতে পারবো না, তোরা ঘুরে আয়”, বলায় আমরা হাঁফ্ ছেড়ে বাঁচলাম, এ যাত্রায় কেউ আর আমাদের মিসগাইড করার রইলো না।
আমরা ছ’জন দুটো টাঙ্গা ভাড়া করে চললাম কাটরা মসজিদ দেখতে।
কাটরা মসজিদ ১৭২৩ এবং ১৭২৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। এখানে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এর সমাধি রয়েছে। মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তার নিজের নামানুসারে নতুন রাজধানীর নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। কাটরা মসজিদটি নতুন রাজধানীর জামে মসজিদ হিসেবে নির্মিত হয়। সে যুগে এতো ইঁট ভাটা না থাকায়, দ্রুত নির্মানের স্বার্থে, আশেপাশের সমস্ত ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে, তার ইঁট দিয়ে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল, যে কারণে ভালভাব লক্ষ্য করলে এই মসজিদের গায়ে, দেবী সরস্বতীর বীণা বা মহাদেবের ত্রিশূলের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল দুই কোণে উঁচু দুটি টাওয়ার, যেগুলোতে বন্দুক স্থাপনের জন্য ছিদ্র রয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে মুর্শিদ কুলি খাঁনের মনে হয়েছিল, তিনি অনেক পাপ করেছেন, তাই তার সমাধি যেন মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচে অতি সাধারণ ভাবে শায়িত হয়, যাতে পুণ্যার্থীদের পদধূলিতে তার পাপের স্খলন হয়, রবিদাও যেন মুরগি হত্যার পাপ স্খলন করে চলেছে বাথরুমে বসে।
কাটরা মসজিদ যাতায়াতের পথে আর একটি একই ধরনের মসজিদ চোখে পড়ে, যার নাম ফুটি মসজিদ। ১৭৭৪ -এ নবাব সরফরাজ খান ওটি তৈরী করতে শুরু করেন, কিন্তু কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নবাব বেহ্স্তে গমন করেন, ফলে মসজিদটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ছাদ না তৈরী হওয়ায় ঐ মসজিদটি ফুটি মসজিদ নামে পরিচিত হয়। একে আমাদের কপাল ফুটো, তাই সাহস করে ফুটি মসজিদ দেখতে টাঙ্গা থেকে কেউ নামলাম না, টাঙ্গা চললো কাঠগোলা প্রাসাদ অভিমুখে।
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে কাঠগোলা বাগানবাড়ি। বাগানে ঘেরা বিশাল স্থাপত্য আর জমকালো সব ভাস্কর্য মুগ্ধ করার মতোই। এই বাগানবাড়ি ফুলের জন্যও বিখ্যাত ছিল। বাগানের নানা ফুলের মধ্যে গোলাপের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। অনেকের বিশ্বাস, কাঠগোলাপের থেকেই বাগানবাড়ির নাম হয়েছে কাঠগোলা।
বাগানবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন জিয়াগঞ্জের রাজা লক্ষ্মীপৎ সিং দুগর। লক্ষ্মীপৎ, জগপৎ, মহীপৎ এবং ধনপৎ – এই চার ভাই এখানে থাকতেন। এখনও বাগানে ঢুকলে দেখা যায় এই চার ভাইয়ের ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। তাঁদের আমলেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আদিনাথের মন্দির। এই জৈন মন্দির কাঠগোলা বাগানবাড়ির অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। শোনা যায়, বাগানের পুব দিকে পুরোনো মসজিদ আর কবরস্থানের পাশে একটি কুয়া থেকে প্রচুর গুপ্তধন পেয়েছিলেন তাঁরা। সে সম্পদের কল্যাণে বাগান এবং মন্দির গড়ে তোলা হয়। অনেকে বলেন, এই চার ভাই ছিলেন দস্যু লুটেরা। আবার কেউ বলেন, তাঁরা আসলে ছিলেন ব্যবসায়ী।
শুনলাম এক সময়ে এই বাগানবাড়িতে নাকি নিয়মিত জলসা হত। নবাব এবং অভিজাতদের যাওয়া আসা ছিল নিত্য। ইংরেজরাও এখানে আসতো। মুর্শিদাবাদে ব্রিটিশদের ক্ষমতালাভের ষড়যন্ত্রেও এই বাগানবাড়ি জড়িয়ে ছিল। বাগানের ভিতর একটি সুড়ঙ্গপথ আছে, যা ভাগীরথীর সঙ্গে যুক্ত। ওই গোপন পথে জগৎশেঠদের বাড়ি যাওয়া যেত বলে শোনা যায়। এখানকার প্রাসাদ, সংগ্রহশালা, বাগান, আদিনাথ মন্দির, চিড়িয়াখানা, বাঁধানো পুকুর, গোপন সুড়ঙ্গ দেখতে ভিড় হয় প্রচুর ।
এবারে আমাদের গন্তব্য জগৎ শেঠের বাড়ি। জগৎশেঠ বাংলার এক ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিত্ব । তৎকালীন সময়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী । জানা যায় জমিদার ও নবাবরা পর্যন্ত কর পরিশোধের ক্ষেত্রে তার অর্থের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। যাঁদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, জগৎ শেঠ তাদের অন্যতম। শুধু চক্রান্তই না পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের অর্থসাহায্যও করেছিলেন তিনি। পরে বক্সার যুদ্ধে মীর কাশেমের হারেও তার হাত আছে বলে মনে করা হয়। মীর কাশেমের হাতেই তিনি সপরিবারে নিহত হন। সে বাড়িতে পুরানো দিনের আসবাব ও নানান মূর্তি ও স্থাপত্য দেখবার মতো।
ইতিমধ্যেই সূর্যদেব প্রস্থানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন, তাই আশেপাশের কম গুরুত্বপূর্ণ স্থান না দেখেই আমরা চললাম বিখ্যাত মতিঝিল দর্শনে। মতিঝিল লালবাগের এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। সুন্দর অশ্বক্ষুরাকৃতি আকারের এই হ্রদটি খাস্তি বেগমের স্বামী নওয়াজেশ মোহাম্মদ খনন করেছিলেন। লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে সুবে বাংলা (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) এর দেওয়ানি অধিগ্রহণের অনুষ্ঠান এই প্রাসাদেই উদযাপন করেছিলেন। নবাব নাজিমের (১৭৭১ – ৭৩ খ্রিস্টাব্দ) দরবারের রাজনৈতিক প্রধান হওয়ার সময় মতি ঝিল ওয়ারেন হেস্টিংসের আবাসস্থল ছিল। প্রাসাদটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিদ্যমান একমাত্র পুরাতন বিল্ডিংটি শাহমাত জাংয়ের মসজিদটি।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে, এবার হোটেলে ফেরার পালা, রবিদাকে এতক্ষণ ভুলে ছিলাম, এবার তার জন্য চিন্তা হচ্ছে।
টাঙ্গার ভাড়া মিটিয়ে হোটেলে ঢুকতেই দেখি রবিদা একটা গামছা পরে মেঝেতে চিৎপটাং, গলার স্বর অতি ক্ষীণ। বললো রাত্রে কিছুই খাবে না। সত্যিই ওর অবস্থা বেশ কাহিল, ডায়েরিয়া হলো নাতো! একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া উচিত। রবিদা রাজি হলো না, শেষে ওষুধের দোকানে বলে চারটে এ্যমবিজাইম ট্যাবলেট সঙ্গে ও আর এস কিনে আনা হলো।
আমরা রাত্রে রুমালি রুটি ও তরকা খেলাম। কাল সকাল আটটায় হোটেল ছাড়তে হবে, তারপর আবার লালগোলা ধরে বাড়ি ফেরা।
এই অভিযানে আমরা হারালাম আমাদের এক অভিযাত্রীকে, যে হয়তো এখন তার বাগানের কাঁঠাল কিভাবে চুঁচুড়ার বাড়িতে নিয়ে যাবে, সেই চিন্তায় মূহ্যমান। আর এক প্রায় অর্ধমৃত অভিযাত্রীকে জীবিত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে, এক মুরগির কল্যাণে শুরুতে যে ছিল আমাদের গাইউ, শেষে আমরাই হয়ে গেলাম তার গাইড।
একেবারে উলটপূরাণ।
আমাদের এই অভিযান যে একেবারে সফল হয়েছে তা বলা যাবে না, তবু এই অভিযান আমাদের বাংলা তথা ভারতের তিনশো বছর আগের ইতিহাসের স্পর্শ অনুভব করতে শেখালো, শেখালো সতীশ ও রবিদার মতো মানুষদের চরিত্র চিনতে।
প্রতি মুহূর্তে কি হয়, কি হয়, ভাব ও তার রোমাঞ্চ উপভোগ করা, বিপর্যয়ের আতঙ্ক ও তা থেকে পরিত্রাণের উল্লাস সহ নানা রঙের উপলব্ধিই হলো আমাদের মূলধন, যা আগামী পথচলাতে নিশ্চিতভাবে কাজে লাগবে। তবে আমরা হাড়েহাড়ে বুঝলাম যে, ওই বয়সে মা-বাবার বিনা পয়সার হোটেলই পৃথিবীতে সুখের একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ ঠিকানা।
===========================
শেষ
previous post
next post