মৃন্ময় ভট্টাচার্য
কুমির তো মাত্র দুটো, আর মানুষ চারজন, তাহলে নিশ্চিত অন্তত দু’জন বেঁচে ফিরবেই, কারণ কুমিরের মুখতো আর রাবনের মতো দশটা নয়, মাত্র একটা, তাই একটা কুমির কিছুতেই দু’জনকে একসঙ্গে খেতে পারবে না। সুতরাং ডাঙায় আমাদের তিনজনের সঙ্গে জলের দু’জন, মোট পাঁচ জনের চুঁচুড়ায় ফেরা নিশ্চিত। তবু খুবই আবেগরুদ্ধ হয়ে শিব, কালী, দুর্গা সহ সব ঠাকুরের কাছে কাকুতি মিনতি করে চলেছি যাতে ওরা চারজনই নিজ নিজ প্রাণ ও দুটো করে ঠ্যাঙ অক্ষত রেখে ফিরে আসে।
মদন আবার বালক ব্রহ্মচারীর শিষ্য, একমনে চোখবুজে তাঁকে স্মরণ করে চলেছে। ভোলা বিজ্ঞান মনস্ক, ঈশ্বর ফিশ্বরে একেবারে বিশ্বাস নেই, ও প্রব্যাবিলিটির অংক কষছে, দুটো কুমিরের দ্বারা সর্বাধিক কতখানি ক্যাজুয়ালটি হতে পারে।
কুমির দুটো লোলুপ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে চুঁচুড়া থেকে ইমপোর্টেড কচি মাংস দিয়ে বেশ জমিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সাড়ার। ঠিক তখনই এক দশাসই দানব আকৃতির (অনেকটা সতীশের কাকার মতো ) এক দেবদূতের আগমন। তিনি তাঁর অমায়িক ( মাইক অপেক্ষা জোরে ) গলায় হাত পা নেড়ে চেঁচাতে লাগলেন "তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, জলে কুমির আছে.....জলে কুমির আছে।"
আমাদের মিসগাইড রবিদা সবার পিছনে সাঁতরাচ্ছিল বলে ওর কানে সেই সতর্কবাণী প্রবেশ করলো, রবিদা বাকি তিনজনকে ওই সতর্কবাণী রিলে করার সঙ্গে সঙ্গেই নদীর জলে তোলপাড় লেগে গেল।
"আগে কেবা প্রাণ সহ রক্ষিবে ঠ্যাঙ
তারি লাগি তাড়াতাড়ি "
নদীর পাড়ে বসে ঠিক যেন অলিম্পিক সাঁতার কম্পিটিশন দেখছি, এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেব, তার উপায় নেই, এতো সাঁতার নয়, যমলোক থেকে মর্তলোকে ফেরার তীব্র প্রচেষ্টা।
রমা গোল্ড, প্রদীপ সিলভার, জয়ন্ত বোঞ্জ আর রবিদা মিলখা সিং বা পি টি উষার মতো একটুর জন্য পদক হাতছাড়া করলো। তবে মদন, ভোলা ও আমাদের পাশে জড়ো হওয়া বেশ কিছু দর্শক যখন আনন্দে হই হই করছে, আমি তখন নিঃশব্দে প্রত্যেকের দুটো করে পা ও দশটা করে পায়ের আঙুল আছে কিনা গুণে গুণে দেখতে লাগলাম।
যাক্ বাবা, আজ কুমিরদের নদীর ঐ চুনোপুঁটি মাছ দিয়েই দুপুরের আহার সম্পন্ন করতে হবে। কুম্ভীরাশ্রু তো দেখা যায় না, তাই ওরা যতো কান্নাকাটিই করুক না কেন, আমাদের মন কিছুতেই গলাতে পারবে না, নেড়া একবারই তো বেলতলায় যায়।
আমার মাথায় একটা খুবই বাস্তব সম্মত ভাবনা খেলে গেল। আমাদের দেশের সাঁতারুরা অলিম্পিক থেকে খালি হাতে যাতে না ফেরে, প্রত্যেক সাঁতারুর জন্য একটা করে কুমির পিছনে লেলিয়ে দিলে কেমন হয়! আমার বন্ধুদের আজকের পারফরম্যান্স দেখে আমার ধারণা, এরফলে সাঁতারে প্রত্যেকটা সোনা ভারতে আসবেই আসবে। এতে বিদেশী ট্রেনার রাখার খরচ অবশ্যই বাঁচবে, আর উন্নতি তো হবেই।
একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পার দৌড়বিদদের ক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে চিতাবাঘ যদি না মেলে, পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিলেই, অলিম্পিকে সোনা আসা এক্কেবারে নিশ্চিত। বাড়ি ফিরে বাকি ইভেন্টগুলো নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার সাজেসানগুলো পাঠিয়ে দেবো।
যাই হোক, ভবিষ্যতের ভাবনা ভবিষ্যতেই করা যাবে, এখন সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে বেঁচে ফেরার আনন্দে আমরা সাতজন সাইকেলে চেপে "যাত্রিক"-এ ফিরলাম। একে একে তিনজন স্নান সেরে নিলাম, এবার খাওয়ার পালা।
গত মধ্যরাতে পলাশীর সেই ভুতুড়ে বাড়িতে কচুপাতায় চাল সিদ্ধ ও ঝাল মেশানো উড়ন্ত মুরগির অংশ কোনোক্রমে গলধিকরণের জ্বালা এখানে হবেনা, এ ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকেই নিশ্চিত।
জয়ন্ত নতুন জীবন ও তার দুর্ভাগ্যকে জয় করে, একটা শ্বেতশুভ্র কাঁচের ডিস, সঙ্গে দুই সুন্দরী চকচকে বাটি ও গ্লাস পেয়েই যে কি আহ্লাদিত, তা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা এই অধমের নেই। এরপর খাবার পেলে কি যে করবে!
ওদিকে রমাপ্রসাদ সবাই কে সঙ্গতি বুঝে খাওয়ার আবেদন করে বসেছে, বিকালে টাঙ্গাভাড়া করে বাকি দর্শনীয় স্থান দেখতে যেতে হবে, রাতের খাওয়া ও কাল সকালে হোটেলে থাকার বিল মেটাতে হবে আর ফেরার টিকিট বাবদ উপযুক্ত ফান্ড রাখতেই হবে। রমার সতর্কবার্তা শুনে, বুঝে খেতে গিয়ে আমাদের দশাও ঐ কুমির দুটোর মতো হয়ে গেল।
যাই হোক গরম ভাত, ঘি, আলুভাজা, ডাল, একটা আলু পটলের তরকারি ও এক পিস মাছ ভাজা দিয়ে খেতে পেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি, জানতে পারলাম রবিদা খাওয়ার দাম দিতে নারাজ, যেহেতু ওনাকে গাইড হিসাবে আনা হয়েছে, তাই ওনার সব রকম খরচের দায়ভার আমাদের, ওনার নয়। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! পকেটের টাকার যা টান ছিল, তা আরও বেড়ে একেবারে টানটান হয়ে গেল। মধ্যাহ্ন ভোজনে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তা বদহজমে পরিণত হওয়ার উপক্রম হলো। সবাইকার মুখ আবার থমথমে। বিকাল চারটের সময় ঘুরতে যাওয়ার আগে এক মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হটেলের খাটে এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত শরীরটাকে। বিকালে আবার কি বিপদ যে আসবে কে জানে!
===========================
এরপর বিকালের ঘটনা (৮)