মৃন্ময় ভট্টাচার্য
হাড় হিম করা দৃশ্য । ঘরের দরজার ঠিক বাইরে, জমাট অন্ধকারের মধ্যে, প্রায় ছ’ফুট উঁচুতে শুধু দুটো সাদা গোল গোল চোখ ও দু’পাটি সাদা দাঁত ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নয়। গম্ভীর কর্কশ গলায় “এই মাঝরাতে কেন এতো চেঁচামেচি ? আমি ওপাশের ঘরে আছি, আর যেন কারও গলার শব্দ আমার কানে না আসে “।
অদৃশ্য হল সেই মূর্তি। ঘরে পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতা। একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাবে। সবাই ভয়ে তটস্থ।
বিদ্রোহী, শব্দ বোমা বর্ষণকারী জয়ন্ত সর্বাগ্রে একটা কচুপাতা সন্তর্পণে টেনে নিল। সবার পাতে নিঃশব্দে ভাত ও সদ্য প্রয়াত মুরগির দেহাংশ পরিবেশন করল রমা। আমরা মুখ বুজে খেতে লাগলাম। মুখে দিয়ে বোঝা গেল চাল তার সব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে এখনও ভাত হয়ে উঠতে পারেনি। আরও ফোটাতে হতো। বাঙাল রাঁধুনির হাতে তৈরি মাংসটা ঘটী সদস্যদের এতখানি কাঁদালো যে রাত্রে খেতে না পাওয়ার দুঃখও এতখানি কাঁদাত কিনা তা গবেষণার বিষয়।
তবু কোনও কথা বলা চলবে না এক অজানা আসুরিক আদেশে। খাওয়া শেষ হতে রাত দেড়টা বাজল। কোনও রকমে এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করে, মাদুর ও দুটো শতরঞ্জি লম্বা করে পেতে, যে যার ব্যাগকে মাথার বালিশ করে, বিবিধ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লব্ধ এই দিনটি থেকে নিমেষে গভীর জ্ঞানহীনতায় ডুব দিলাম ।
সহ্য করতে পারলে সব অন্ধকারই কালের নিয়মে একসময় কেটে যায়। প্রভাতসূর্য খোলা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সর্বপ্রথম আমার ঘুম ভাঙাল। ঘরের দেওয়ালে পাঁচ বছরের পুরানো গণেশ ঠাকুরের ছবি দেওয়া একটা ক্যালেন্ডার চোখে পড়ছে। দিনের প্রথম আলোয় এই কয়েদ খানার চার দেওয়ালের দিকে দু’চোখ মেলে প্রথমবার দেখতেই, রবি ঠাকুরের বাঁশি কবিতায় হরিপদ কেরানীর সেই ঘরটির কথা মনে পড়ে গেল।
নোনা-ধরা দেওয়ালেতে
মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ।
মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার ‘পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব।
অন্নের অভাবে যে কি দশা হয়, গতকালই তা টের পেয়েছিলাম। আজ আর এক মুহূর্তও এই কারান্তরালে থাকার কোনও ইচ্ছা আমার নেই।
কাল রাতে বাজার এনে দেওয়ার পর থেকেই সতীশ নিরুদ্দেশ ছিল। এই ভোরবেলা হাস্যমুখে আবার তার উদয় দেখে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হলাম। সতীশের গলার শব্দে একে একে সবাই গাত্রোত্থান করল।
প্রথমেই সতীশকে গতকাল রাতের সেই অপার্থিব ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে চাওয়া হল। সতীশ হো হো করে হেসে উঠল। বললো ওর কাকা দুদিন আগেই এসেছে। ও গতকাল রাত্রে কাকার সাথে একই খাটে ঘুমিয়েছে। কাকা লম্বা ও গায়ের রঙ মিশমিশে কালো বলে মিছিমিছি আমরা ভয় পেয়েছি। ওর কাকা নাকি খুব ভাল মানুষ।
ভাল না খারাপ তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। শুধু মানুষ হলেই যথেষ্ট। ভূত, দেবতা, দৈত্য, দানব নিয়েই আমাদের যত ভয়। তবু, আজ সকালেই আমরা এই বেসক্যাম্প ছেড়ে মুর্শিদাবাদ জয়ের লক্ষ্যে অগ্রসর হব।
সতীশ বলল, সকালে নয়, বিকালে যাস। ট্রেনে মাত্র এক ঘন্টার পথ। এবেলা চল আমাদের বাগানে, সবাই মিলে কাঁঠাল পাড়তে যাব। সঙ্গে কাকাও থাকবেন।
ভোলার মাথাটা ভাল। ও বুঝে গেল সতীশদের বাগানের কাঁঠাল পাড়া ও বহন করবার শ্রমিক হিসাবে, দারুণ পরিকল্পনা করে আমাদের এখানে আনা হয়েছে। ভোলা প্রথমে আপত্তি করল। আমরা টিউবলাইটের মতো দেরি হলেও জ্বলতে জানি। সতীশের ছক যখন স্পষ্ট হয়ে গেল সবার কাছে, সবাই কাঁঠাল বাগানে যেতে অস্বীকার করল। এই সকালেই সতীশের মুখে যেন সন্ধ্যা নেমে এল। যখন বুঝল বাগানে আমরা কিছুতেই যাব না, তখন আগামীকাল মুর্শিদাবাদ থেকে ফেরার সময় যাতে আমরা আবার যেন পলাশীতে নামি এবং কাঁঠালগুলো চুঁচুড়া পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করি, তার অনুরোধ রাখল। তবুও আমাদের কারও কাছ থেকে কোনও সদর্থক প্রত্যুত্তর পেল না।
ভোলা ওর ব্যাগ থেকে টাইম টেবিল বার করে ট্রেনের সময় দেখতে লাগল। টাইম টেবিল অনুযায়ী এখনও একঘন্টা পরে লালগোলা প্যাসেঞ্জার পলাশী পৌঁছনোর কথা। কিন্তু তার ওপর আধ ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা দেরিতে আসা এযুগে লালগোলার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই মদনের ইচ্ছা ফাঁকতালে একবার দিনের আলোয় পলাশীর ভাগীরথী দর্শনের ।
রমা দায়িত্ব নিল পাঁউরুটি মাখনের বন্দোবস্ত করে প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করার। মদন ও আমি চললাম ভাগীরথী দর্শনে।
পলাশীর সেই বিখ্যাত আম্রকুঞ্জের গা ঘেঁসে প্রবহমান এক খরস্রোতা শীর্ণকায় জলরাশি। এটাই কি আমাদের ভাগীরথী! বিস্মিত হয়ে দেখি ওপারের সবকিছু স্পষ্টতই দৃশ্যমান। একে নদী না বলে খাল বলাই শ্রেয়। আমাদের ওখানে তো এই ভাগীরথীর ওপারের কোনও কিছুই স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। ওখানে ভাগীরথী অন্তত এর দশগুন চওড়া।
আসলে আমাদের দাদু-ঠাকুমারা শেষ বয়সে অনন্তে বিলীন হওয়ার প্রস্তুতিস্বরূপ মনকে অনেক প্রশস্ত, উদার করে যেভাবে সকলের সম্মান অর্জন করেন, তেমনই নদীরাও অনন্ত সমুদ্রে বিলীন হওয়ার পূর্বে সঙ্কীর্ণতা ত্যাগ করে নিজেকে প্রশস্ত করে সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়।
ঘরে ফিরে চার পিস পাঁউরুটির সঙ্গে এক ভাঁড় চা, কোনওরকমে গলধঃকরণ করে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে চললাম পলাশী স্টেশন অভিমুখে। পিছনে পড়ে রইলো এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। শ্রীযুক্ত বাবু সতীশচন্দ্র ও তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভূতুড়ে বাড়ি।
পলাশী থেকে সাতটা স্টেশন মুর্শিদাবাদ। সময় লাগবে এক ঘন্টা। টিকিটের দাম তিন টাকা। রবিদার উপর বিশ্বাস হারানোর ফলে সবাই যে যার নিজ নিজ টিকিট কেটে নিলাম। ট্রেন এলো পঁচিশ মিনিট দেরিতে। গন্তব্য চির আকাঙ্খিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী রহস্যময় ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ। সেখানে যে কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে!
এরপর……… ৬
