April 29, 2025
সাহিত্য

মুর্শিদাবাদ অভিযান (২)

মৃন্ময় ভট্টাচার্য

ট্রেন চলেছে তার নির্দিষ্ট পথে, আমরা সবাই গুম মেরে বসে আছি, রবি দাদার কীর্তি জেনে সবাই মর্মাহত। মনে হচ্ছে এই পথ কেন না শেষ হয়! পলাশী ষ্টেশন আসতে চলেছে, আমাদের সেনাপতিকে এখনই মীরজাফর আখ‍্যা দেওয়া হচ্ছে না। এই বিদেশ বিভুঁয়ে বিদ্রোহ করার সাহস আমাদের কারো নেই, বাড়ি ফিরে নিজ গড়ে পৌঁছে এসব হিসাব নেওয়া যাবে।

ট্রেন পলাশী পৌঁছতেই আমরা অবাক, প্ল‍্যাটফর্ম থেকে বের হবার মুখেই, ঠিক আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় মদন মোহন সেনের মতো একজন দাঁড়িয়ে! আরে! মদনের মতো নয়, এ যে আমাদের মদনই!

মদনেরও ইচ্ছা ছিল আমাদের এই অভিযানে সঙ্গী হওয়ার, বাবা-মা’র কনফারমেশন না পাওয়ায়, আমাদের কনর্ফাম করেনি, কিন্তু গতকাল আমার থেকে বিশদে সব পরিকল্পনা জেনে নিয়েছিল। আজ নৈহাটী পৌঁছে আমাদের খুঁজে না পেয়ে, একেবারে সামনের দিকে একটা কামরায় উঠেছিল। পলাশীতে আমরা একত্রিত হলাম। এখন আমাদের বাহিনী সাতে থেকে আটে উত্তীর্ণ হলো।

এখানে দেখলাম ঘোড়া চালিত টাঙ্গা গাড়ি চলে। দুটো টাঙ্গায় চার জন করে আটজন বসলাম। যেহেতু এখনো সন্ধ‍্যা নামেনি, তাই টাঙ্গাওয়ালাকে বলা হলো আগে সেই ঐতিহাসিক আমবাগান দেখে তারপর সতীশদের বাড়ি যাবো।

আমরা চলেছি সেই পলাশীর প্রান্তরে, “বাঙালির খুনে লাল হলো যেথা ক্লাইভের খঞ্জর”। যেখানে ডুবেছিল ভারতের স্বাধীনতার দিবাকর। যখন আমাদের সবারই খুব রোমাঞ্চ হচ্ছে। হঠাৎ টাঙ্গা দুটো থেমে গেল। কি হলো, থামলেন কেন?

আপনারা তো বলেছিলেন আমবাগান দেখবেন! রবিদা ধমক দিয়ে বললো, এরকম আমবাগান আমাদের ওখানে শত শত দেখা যায়, যেখানে ক্লাইভ আর সিরাজের যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে নিয়ে চলো। সকলকে অবাক করে টাঙ্গাওয়ালা বললো “বাবু, এটাই তো সেই আমবাগান “।

এ‍্যাঁ, বলে কি! নেই কোনো ফলক, নেই কোনো স্মৃতিসৌধ, একেবারে অবহেলায় পড়ে আছে এমন ঐতিহাসিক স্থান! সারা ভারত পলাশীকে চেনে এই স্থান মাহাত্ম্যর জন‍্যই। আর তার কিনা এই দুর্দশা! এটাকে বিরাট টুরিস্ট স্পট তৈরী করা যেত, তাতে বহু দেশী বিদেশী মানুষের সমাগম হতো, এই অঞ্চলের আর্থিক বিকাশও ঘটতো। সরকার করছেটা কি!

টাঙ্গা থেকে নামতে আর ইচ্ছা করলো না। হঠাৎ আমাদের দেখে কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন জিজ্ঞাসা করে ববসলেন ” ভাই তোমরা আসছো কোথা থেকে?”

চুঁচুড়া বলতে গিয়ে ভাবলাম চুঁচুড়া বললে বলতে হবে চুঁচুড়া কোথায়, কোন জেলায় ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি, তাই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে দিলাম “কলকাতা থেকে।” কলকাতার ছেলে জানলে একটু বেশি সম্ভ্রমের চোখে দেখবে।

“কলকাতার কোথায় থাকো?” গেলাম ঘাবড়ে, আমিতো ধর্মতলা ছাড়া আর কোনো যায়গার নাম শুনিনি, বলে দিলাম “ধর্মতলা”। লোকটি একটা ব‍্যঙ্গাত্বক মুচকি হাসি হেসে প্রস্থান করলেন।

আমার পাশে বসা মদন আমাকে খোঁচা দিয়ে বললো “ধর্মতলা তো অফিস পাড়া, ওখানে কি লোক বাস করে?” ভোলা বললো “ভাগ‍্যিস চিড়িয়াখানা বলেনি “, রমা বললো “শ‍্যামবাজার, বাগবাজার, টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ, কালীঘাট, কোনোটার নামই তুই শুনিসনি?”
শুনেছিতো, সে সময় যে সব গুলিয়ে গিয়েছিল, সরি।
এবার চলেছি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিশ্রাম দিতে সতীশদের সেই পৈত্রিক বাড়িতে। গিয়েই একটা নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেব।
সন্ধ‍্যা নেমেছে, আলো আঁধারির মাঝে টাঙ্গা থামলো এক জীর্ণ প্রায় পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ির সামনে। একমাত্র এই বাড়িটা ছাড়া বাকি সব বাড়িই আলোকোজ্বল। সতীশ বললো কেউ থাকেনা বলে বিদ‍্যুতের লাইন কাটা আছে, কে বিল জমা দিতে আসবে বল।

আমার বিশ্রামের ভাবনা মাথায় উঠলো। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে উঠোন, যেন সুন্দর বনের ক্ষুদ্র সংস্করণ। টর্চ জ্বালতেই কচু গাছের বড় বড় পাতাগুলো আমাদের স্বাগত জানালো। ভীতরে ঢুকে বুঝলাম এই ভুতুড়ে বাড়িটা এল সেপের। অপর প্রান্তে এক সরু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে অতি সন্তর্পণে আমরা দোতলায় পৌঁছলাম। রাস্তার ধারের একটা বড় ঘর, আসবাব বলতে একটা মাদুর আর দুটো শতরঞ্জি। সঙ্গে ফাউ হিসাবে ডেঙ্গু বাহিনীর জলসার জ্বালাতন, এটা যেন কোনো বিনি পয়সার রক্তদান শিবির। আশঙ্কা বেঁচে ফিরবো তো!

কুলুঙ্গিতে পাওয়া গেল দুটো আধপোড়া মোমবাতি। ভোলার কাছে লাইটার ছিল, জ্বালানো হলো। আমরা সবাই ঘরের একটা কোনে, আমাদের ব‍্যাগগুলো নামিয়ে রাখলাম। সবার পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। এখানে খাবার কিচ্ছু নেই। এটাকে শহর বলা যায় না, তাই আশেপাশে কোনো হোটেলও নেই। আমাদের মধ‍্যে সতীশকেই একমাএ উৎফল্ল দেখাচ্ছে। সতীশ বললো রাস্তার ওপারে ওই বাড়িতে আমি একটু কাকীমা ও দিদির সাথে দেখা করে আসছি।

ব‍্যাস, এই পাণ্ডব বর্জিত রাজ‍্যে আমরা সাতটি অসহায় প্রাণী, আসন্ন খাদ‍্যসঙ্কটের আশঙ্কা নিয়ে রাত্রি যাপনে বাধ‍্য হচ্ছি। এই পলাশীতেই ভারতের পরাধীনতার সূত্রপাত আর এখন আমাদের জীবন বন্ধক রেখে মশক বাহিনীর সাথে চলছে বেঁচে থাকার লড়াই। মোমবতি ফুরিয়ে গেলে ভুতুড়ে বাহিনী যে যুদ্ধক্ষেত্রে পদার্পণ করবে না, কে বলতে পারে!

এখনও অনেক বাকী…….

   

===========================

Related posts

Leave a Comment