মৃন্ময় ভট্টাচার্য
শনিবার, পরন্ত দুপুরে হঠাৎই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। নিশ্চয়ই কোনো সেলসম্যান এসেছে কিছু না কিছু গছাতে। একবার সামনে পেলেই গছিয়ে ছাড়বে, ওদের এমন ট্রেনিং দেওয়া হয় যে ওরা একেবারে নাছোড়বান্দা তৈরি হয়। অচেনা এই ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য মায়াও হয়। শিক্ষিত হয়েও ফেরিওয়ালার মতো দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে পেটের দায়ে বা সংসারের চাপে। তাই খারাপ ব্যবহার করতেও ইচ্ছা করে না।
সেজন্যই কলিং বেলের ডাকে সাড়া দিলাম না, ঘরের ভিতরে বসে মোবাইল নাড়াচাড়া করতে লাগলাম আগের মতোই।
আবার বেজে উঠলো বেলটা, একটু বিরক্ত হয়েই গেলাম দরজায়। দেখি এক অচেনা যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম ‘কে ভাই, কি দরকার একটু তাড়াতাড়ি বলো ‘।
ছেলেটি বিস্ময় মাখানো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন না!’ আমি না চিনতে পেরেও বোকা বোকা মুখে বললাম ‘ও হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি, কেমন আছো।’
ছেলেটি বললো ‘ভালোই আছি স্যার, জানেনতো আমি WBCS দিয়ে BDO র চাকরি পেয়েছি।’ আমি চমকে গেলাম, নিশ্চিত হলাম ছেলেটি সেলস্ ম্যান নয়, পকেট কাটার ধান্ধায় আসেনি। একটু খাতির করেই বললাম ‘ভিতরে এসো।
বাইরের ঘরে বসার আগেই ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে হলুদের টিপ ও প্রজাপতি লাগানো একটা বিয়ের কার্ড বের করলো। “স্যার, আগামী শুক্রবার বিয়ে, রবিবার সন্ধ্যায় বৌভাতে আপনাকে আসতেই হবে ।”
আমি আরও একটু ঘাবড়ে গেলাম, কে এই ছেলে! আমাকে কেন হঠাৎ বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এলো রে বাবা! একে মাসের শেষ, সেলসম্যান হলে ভাগিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু এই অচেনা আগন্তুক নিশ্চিত আমার পূর্ব পরিচিত, (কার্ডের খামে লাল কালিতে যখন আমার পিতৃদত্ব নাম ও পদবী সঠিকভাবেই লিখে এনেছে ) তাকে কি তাড়ানো যায়!
হঠাৎই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বোকা বোকা ভাবটা উবে গেল, মস্তিষ্ক বলে দিল “ওর পরিচয় কার্ডে মধ্যেই পেয়ে যাবি”, কার্ড খুলে দেখি ছেলেটির নাম শুধু নয়, বাপ-মা-ঠাকুর্দা-ঠাকুর্মা, বাড়ির ঠিকানা সবই বিস্তারিতভাবে লেখা রয়েছে। আমি আরও একটু স্বপ্রতিভ হয়ে বললাম “অর্ণব, চা না কফি কি খাবে বলো “
“অর্ণব নন্দী”-র সঙ্গে এই আমার সদ্য পরিচয় তার বিয়ের কার্ডে পাত্রের নাম দেখে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, মনে আবার এক দুশ্চিন্তা দেখা দিল, ছেলেটি তো বলেনি ‘আমার বিয়ে’ বলেছে ‘বিয়ে’, যদি এই ছেলেটার দাদার নাম অর্ণব হয়, তাহলে আমি তো একদম ফেঁসে যাব!
ছেলেটি বললো “না স্যার একদম সময় নেই, অনেকগুলো বাড়ি ঘুরতে হবে, পরে একদিন আসা যাবে। স্যার, আপনাদের সেই কালো রঙের ল্যাব্রাডর কুকুরটা এখনো বেঁচে আছে? যখন পড়তে আসতাম, ওর সঙ্গে বল নিয়ে না খেলে বাড়িই ফিরতাম না, আপনার মনে পড়ে?”
যাক বাবা মনে হয় ওরই বিয়ে, এবার বহু বছরের ধুলো জমা স্মৃতি, একটু একটু করে স্বচ্ছ হচ্ছে, সেই অর্ণব যে এই অর্ণব তা বোঝার উপায় নেই, সেই সরু, গাল তোবড়ানো, প্যালপ্যালে রোগা ছেলেটি যে আজ সুঠাম চেহারার সিনেমার নায়কের মতো যুবকে পরিণত হতে পারে, তা আমার কল্পনাতেও আসে নি।
বললাম “নাগো সে আর নেই, বছর দুয়েক হলো মারা গেছে।”
অর্ণব, তুমি যে আমাকে এখনো মনে রেখেছো, তাতেই আমি অবাক হয়ে গেছি! তোমার সঙ্গে আর যারা পড়তো, তারা তো রাস্তায় সামনা সামনি দেখা হলেও চিনতে পারে না, তুমি সত্যিই ব্যতিক্রমী।
স্যার, আজ আমি জীবনে যেটুকু সাফল্য পেয়েছি, তাতে আপনার অবদান কি করে ভুলি বলুন, মনে পড়ে আমার কলেজে ভর্তি হওয়ার ফি-টা আপনিই দিয়েছিলেন! আমি বাবা-মা’কে যে চোখে দেখি, আপনাকেও সেই চোখেই দেখি।
হঠাৎ অর্ণব আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো, আবেগে অভিভূত হয়ে, অশ্রু সজল চোখ, অর্ণবকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম। অর্ণবও চোখ মুছতে মুছতে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে বিদায় নিল।
আমি হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই টিউশনি ধরেছিলাম, সাংসারিক চাপে নয়, নিজের হাতখরচ নিজে চালাব বলে। পড়াতাম ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টেনের ছাত্রদের। তখনই অর্ণব ও আরও দু-চার জন আমার কাছে পড়তে আসতো। চাকরি পাওয়ার আগে, বছর তিনেক এভাবেই চালিয়েছিলাম। সেই সব ছাত্রদের নাম আজ আর মনে আসে না। অর্ণব আজ সেই সুখস্মৃতি নতুন করে উষ্কে দিল।
যে ছেলেটি এভাবে আমাকে সম্মানিত করলো, তার জীবনের নতুন অধ্যায়ে সূচনাতে আমি উপস্থিত থাকব না, তা কি হয়!
এসে গেল রবিবার। কি পোশাক পরব ঠিক বুঝতে পারছি না, জীন্সের প্যান্ট ও টি শার্ট পড়া উচিত হবে না, মাষ্টারমশাই বলে কথা। শেষে ঠিক করলাম গত জামাইষষ্ঠীতে পাওয়া সাদা পাঞ্জাবী ও সাদা কুর্তাটাই পড়া সঠিক হবে। মাস শেষের অসুবিধা উপেক্ষা করে, একটু দামি বিছানার চাদরের সেট ও একটা সুন্দর ফুলের তোড়া নিয়ে স্কুটার চালিয়ে চললাম অর্ণবের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে চন্দননগরের নাড়ুয়ার একদম শেষপ্রান্তে আলোয় ঝলমল বিয়েবাড়ি চোখে পড়লো, স্কুটারটা একপাশে রেখে বাড়িটাতে ঢুকতে গিয়েও থমকে গেলাম, তত্ত্ব হাতে কন্যাযাত্রীদের দল লাইন করে ঢুকছে, প্রচন্ড ভিড়, এখন ঢোকা সম্ভব নয়। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম একপাশে, যেন এক অনাহুত অতিথি। কি আর করা যাবে, একটাও চেনা মুখ চোখে পড়ছে না। এতো ভিড়ের মধ্যেও নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছে। কন্যা যাত্রীরা ঢুকে যাওয়ার পর, যখন দরজার সামনে জটলাটা একটু ফিকে হয়েছে, পকেট থেকে চিরুনীটা বারকরে স্কুটারের হাওয়ায় এলোমেলো হওয়া অবশিষ্ট একগাছা চুলকে স্বযত্নে আঁচড়ে দরজার সামনে যেতেই দেখলাম থার্মোকল দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে “পলাশ ওয়েডস্ সর্বাণী”। সর্বনাশ, এতো অর্ণবের বাড়ি নয়! ভাগ্যিস লেখাটা চোখে পড়েছে, না হলে কি বিপদেই না পড়তাম! গির্ফটগুলো যদি নতুন বউয়ের হাতে দিয়ে দিতাম, তাহলে কি হত! দিয়ে ফেরত নিতে তো পারতাম না!
ফিরে এলাম স্কুটারের পাশে, প্রায় আধঘন্টা সময় বরবাদ হয়ে গেল। এক মাঝবয়সি পথচারীকে পেয়ে গেলাম, আমার দুর্দশার কথা তাঁকে বলতেই, তিনি বললেন ” ঐ যে সামনে লাইটের পোষ্টটা দেখছেন, ওর ডানদিকে যে গলিটা ঢুকেছে, সোজা কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে দেখবেন আর একটা বিয়েবাড়ি আছে, দেখুন ওটা হতেও পারে।” বেজার মুখে ভদ্রলোককে শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট উদভ্রান্ত পথিকের মতো অচেনা পথে এগিয়ে চললাম দ্বিতীয় টার্গেটের দিকে।
গলির গলি তস্য গলির মধ্যে আলোর রেখা আবারও স্পষ্ট হ’ল, তবে ধন্ধ দূর হ’ল না, কারণ এখানে প্রবেশদ্বারে লেখা নেই স্বেচ্ছায় আজীবন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চাওয়া দুই অবুঝ নর-নারীর নাম।
কি করব এবার! যাচাই না করে আগেভাগে নববধূর হাতে গিফট কিছুতেই তুলে দেব না। এবার মাথার এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়াবার ইচ্ছাকে ত্যাগ করে, সটান গেলাম ভিতরে, এখানেও সবাই অচেনা, বুঝলাম কন্যা যাত্রীও এসে গেছে। অর্ণবকে তো দেখছি না! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ” এটা কি অর্ণব নন্দীর বাড়ি? ” তিনি বললেন দাঁড়ান দেখছি”, তাঁর এই কথা শুনে আমার টেনশন বহুগুণ বেড়ে গেল। তিনি অন্য একজনকে বললেন ” হ্যাঁরে মিন্টুর ভাল নাম কি অর্ণব?” সদর্থক উত্তর আসাতে আমি হতাশা মুক্ত হলাম। ” অর্ণবকে একটু ডেকে দেবেন?” বলাতে এক ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, “ও ভীষণ ব্যস্ত, দেখছেন না কন্যাযাত্রীরা এসেছেন, অপেক্ষা করুন।” আমি করুণ বদনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হঠাৎ দেবদূতের মতো অর্ণবেব দেখা মিললো। চোখাচুখি হতেই দৌড়ে এলো, “স্যার আপনি এসেছেন, কি ভালোই না লাগছে।” আমি গিফটগুলো হস্তান্তরের আগ্রহ দেখাতেই অর্ণব বলে উঠলো ” ঐ ঘরে এখন ভীষণ ভিড়, বরং চলুন খাওয়ার ব্যবস্থা করি “। অগত্যা অর্ণবের হাতেই ওগুলো তুলে দিয়ে বোঝামুক্ত হলাম।
চারজন করে বসার এক একটা টেবিল, কোনো টেবিলই ফাঁকা নেই। অর্ণবকে চারিদিক থেকে একাধিকবার লোকে ডেকে চলেছে, তবু আমাকে ছেড়ে ও যেতে পারছে না। ওর এই অবস্থা দেখে সদ্য খেতে বসা এক ভদ্রলোক তাঁর চেয়ারটা আমাকে ছেড়ে দিলেন। কেটারারদের প্রধানকে ডেকে আমি যে অর্ণবের স্যার তা জানিয়ে আমাকে বিশেষভাবে দেখতে বলে অর্ণব বিদায় নিল। নববধূকে আশীর্বাদ করা বা অর্ণবের বাবা-মা’র সঙ্গে আলাপ করার কোনো সুযোগ আমি পেলাম না।
আমার পাশেই এক সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি খেতে বসেছেন। ক্যাটারারের মালিক ঠায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যারা পরিবেশন করছে তারা বারেবারে আমার কাছে আসছে, আর কি লাগবে জিজ্ঞাসা করছে। এই মাত্রাতিরিক্ত খাতির উপভোগ করতে খারাপ লাগছে না। অর্ণবের বাবা-মা এসে আমার সঙ্গে বুড়ি ছোঁওয়ার মতো করে দেখা করে গেলেন, তাতে খাতিরের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। পাশের বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাঝে মাঝে ক্যাটারারদের ডাকছেন, তারা যেন শুনতে পাচ্ছে না।
বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দুটো রসগোল্লা দিয়ে আমাকে একসাথে চারটে রসগোল্লা দিতেই, বৃদ্ধ রেগে দাঁড়িয়ে উঠলেন, বললেন “আমিও নিমন্ত্রিত, দেখছি শুধুই আমার পাশের ব্যক্তিকে খাতির করা হচ্ছে, আমি চললাম।” বলে যেই পা বাড়িয়েছেন অমনি ওনার হাটুতে লেগে ওনার পাতের রসগোল্লার রসের সাথে মাংসের ঝোল ও নানান এঁটোকাঁটা পড়লো আমার সাদা পাঞ্জাবী কুর্তার ওপর। আমার পেট, থাই সব চটচটে হয়ে গেল, তা দেখেও বৃদ্ধ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাঁটা দিলেন। জল ঢালা হলো আমার পোশাকে, পায়ের সঙ্গে পোশাক লেপ্টে গেল। সাদা পোশাক এখন আশি শতাংশ স্বচ্ছ হয়ে গেছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “উলঙ্গ রাজা” কবিতাটির “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?” লাইনটা মনে পড়ে গেল। হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবী ছিল বলে কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করে, কারো সঙ্গে দেখা না করেই, দ্রুত বিয়েবাড়ি ছেড়ে বেছে বেছে অন্ধকার পথ খুঁজে, কোনোরকমে বাড়িতে পৌঁছলাম।
স্ত্রী দরজা খুলে আমাকে দেখেই. ………….. …., না গৃহশান্তি বজায় রাখতে, এর বেশী কিছু জনসমক্ষে না বলাই ভাল।
next post