April 9, 2025
কলকাতা

বিথারী বাওড়ের রাজনীতিতে কোণঠাসা তৃণমূলের বিরোধী শিবির

সুভাষ পাল, বিথারী, ২১ মে: বাওড়ের জলাশয় ভরাট ও জমির চরিত্র বদলের অভিযোগকে কেন্দ্র করে আজ ফের আরও একবার রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াল মথুরামোহনের বিথারী-হাকিমপুর গ্রামপঞ্চায়েতে। গত ১৭ মে এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে একটি আক্রমণাত্মক সভা করে তৃণমূলের বিরোধী গোষ্ঠী। সেই সভার অভিযোগের জবাব দিতেই আজকের এই সভার ব্যাপক জমায়েত হয় রেজাউল মণ্ডল ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে। কিন্তু সেই জমায়েতকে ছাপিয়ে প্রায় দশ গুণ বেশি জমায়েত হয়েছে বলে দাবি, জিয়াউর রহমান মোল্লা ও আনিস উদ্দিন গাজীদের গোষ্ঠীর।

তৃণমূলের জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের একটি নির্দেশে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়ল বিরোধী শিবির। সভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেন, দলের যে সব বুথ সভাপতি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, তাঁদেরকে সরিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে বুথ সভাপতি করার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হল স্বরূপনগর উত্তর ব্লকের সভাপতি জিয়াউর রহমান মোল্লাকে।

যদিও জিয়াউর গোষ্ঠীর একাংশের দাবি, বিরোধী গোষ্ঠী যে জমায়েত করেছিল, তা স্বরূপনগরের দশটি পঞ্চায়েত থেকে লোক আনা হয়েছিল। কিন্তু, আজকের সভাটিতে যে ব্যাপক জমায়েত হয়েছে, তা শুধুমাত্র বিথারী-হাকিমপুর গ্রামপঞ্চায়েতের মানুষই অংশগ্রহণ করেছেন। ১২ জুন বনগাঁতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ারের প্রস্তুতি সভা বলে প্রচারিত হলেও মূলত এটি ছিল শত্রু পক্ষকে পাল্টা আক্রমণের সভা। আজকের এই সভায় উপস্থিত হন বিথারী গ্রাম পঞ্চায়েত, স্বরূপনগর ব্লক ও বনগাঁ জেলার শীর্ষ নেতৃত্ব ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। উপস্থিত ছিলেন স্বরূপনগরের বিধায়ক বীণা মণ্ডল, তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস (বিজেপি থেকে আগত বিধায়ক), জেলার সহ সভাপতি ও স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ রমেন সর্দার, বিথারী গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান লিমা গাজী সহ অন্যান্যরা।

এদিন স্বাভাবিকভাবে রমেন সর্দার বক্তৃতার মাঝে বিথারী বাওড়ের জমির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে বিরোধী গোষ্ঠীর ওপর যথেষ্ট আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ত্রিশ বছর আগে আমরা এই বাওড়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এসেছি। কিন্তু তখন এইসব কুৎসার রাজনীতি করা হয়নি। তৃণমূল নেতাদের মানুষের সামনে ছোট করে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই রাজনীতি করা হচ্ছে। দলে যদি কোনও সমস্যা থাকে, কারও বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ থাকে, সেটা দলের মধ্যেই আলোচনা করতে হয়। এটাই দলীয় রাজনীতির নিয়ম। কিন্তু একশ্রেণীর লোকজন সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরণের ঘৃণ্য রাজনীতি করছে।

প্রসঙ্গত, বিথারীতে নদীর পরিত্যক্ত অংশ বলে পরিচিত অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বা জলাশয় বাওড় নামে পরিচিত। যেখানকার জল মূলত মাছ চাষ, সেচ, রান্না ও স্নানের কাজে ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘ সময় মাছ চাষ করার ফলে একসময়ে এই জলাশয় ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে আসে। বাওড়ের বিভিন্ন খন্ড পৃথক পৃথক মালিকের অধীনে চলে যায়। প্রতি খন্ডে আলাদা আলাদা বাঁধ বা ভেড়ি রয়েছে। এই বাওড়ের এরকমই একটি খন্ডের মালিক হারান সরদার নামে এক মাছ ব্যবসায়ী। যা মথুরামোহনের পরিবারের বাওড়ের ঠিক উত্তর দিকে অবস্থিত। হারান সরদার ২১ বিঘা এই বাওড়ের অংশটি প্রায় দুই দশক আগে কিনে মাছ চাষ শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি সেই বাওড় ড্রেজিং করার সময়ে “দেলঘাট” বলে দাবি করা এই জলাশয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বর্ধিত অংশ ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে ভরাট করতে শুরু করেন। যা নিয়ে সরব হয়ে ওঠে তৃণমূলের বিরোধী গোষ্ঠী বলে পরিচিত রেজাউল মণ্ডলের অনুগামীরা।

অভিযোগ করা হয়, স্বরূপনগর বিডিও অফিসে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে স্বরূপনগরের বিএলআরও পলাশ বালা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। তিনি বাওড়ের ওই বর্ধিত অংশ ভরাট করা বন্ধ করতে বলেন। এবং ভরাট অংশে যে মাটি ফেলা হয়েছে, তা তুলে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। সেইমতো হারান সরদার স্বরূপনগর ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের নির্দেশ মতো মাটি ফেলা অংশে পুনরায় ড্রেজিং করে মাটি তুলে দেন। এবং বর্ধিত জলাশয়টিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন।

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান অভিযোগকারীরা। এর প্রেক্ষিতে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন খবর ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও খবরের শিরোনামে বলা হয়, মথুরামোহনের বিথারী বাওড় দখল করা হয়েছে। আবার কোথাও অভিযোগ করা হয়, তৃণমূলের স্বরূপনগর উত্তর ব্লকের সভাপতি জিয়াউর রহমান মোল্লা তাঁর নামে থাকা বাওড়ের জমির চরিত্র বদল করে জলাশয় থেকে বাস্তুতে রূপান্তরিত করেছেন। উল্লেখ্য, ৯৬ বর্গ ফুটের এই জমিটি তিনি ২০২১ সালে হারান সরদারের নিকট থেকে কিনে নেন। এছাড়া অভিযোগ করা হয়, তিনি ৫২ বিঘা জমি বাস্তুতে রূপান্তরিত করেছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বরূপনগরে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

সূত্রের খবর, হারান সরদারের এই জমি “বাংলার ভূমি পোর্টাল”-এ দাগ নাম্বার দিয়ে অনুসন্ধান করলে বাস্তু বলে রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে। আবার খতিয়ান নাম্বার দিয়ে অনুসন্ধান করলে জলাশয় দেখাচ্ছে। এবিষয়ে বিএলআরও-এর কাছে গেলে জানানো হয়, এটা ভূমি দপ্তরের ভুল। ওটি বাওড়ই আছে। শুধু সিস্টেমের ভুলের কারণে অনলাইনে বাস্তু দেখাচ্ছে। একটি কোডের ভুলের জন্য ২০০৯ সাল থেকে এই ভুল থেকে গিয়েছে। বিএলআরও পলাশ বালা প্রতিশ্রুতি দেন, অবিলম্বে এই ভুল সংশোধন করা হবে।

এদিন সভার মাঝে তৃণমূল নেতা জিয়াউর রহমান মোল্লা সেই বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘অবাস্তব কথা রটানো হচ্ছে। ৫২ বিঘা জমি কখনও বাস্তুতে পরিণত হয় না বা করা যায় না। একজন বিএলআরও-এর পক্ষে সর্বোচ্চ ১০ শতক জমি বাস্তু করার ক্ষমতা আছে। তার বেশি হয় না। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে। কুৎসা রটানো হচ্ছে। আমার নামে থাকা জমিতে এক বিন্দুও মাটি পড়েনি। এবং সেটি খাতায় কলমে আজও জলাশয়ই আছে। আসলে একসময় একশ্রেণীর মানুষ পঞ্চায়েতের ক্ষমতা পেয়ে করে কম্মে খাচ্ছিল। আমি দলের ব্লক সভাপতি হওয়ার পর তাদের সেই ধান্ধা বন্ধ হয়ে যেতেই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছে।’

অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের দাবি, এলাকায় এতো লোক থাকতে বাওড়ের মালিক জিয়াউর রহমানকে কেন জমি বিক্রি করল? এরমধ্যে নিশ্চয় কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। এর জবাবে হারান সরদারের ছেলে আশিক সরদার বলেন, আমার বাবার একটাই ভুল, এই বাওড়ের একটি অংশ একজনকে বিক্রি করেছিলেন। সেই ক্রেতা একজন সাধারণ নাগরিক হলে কোনও প্রশ্ন তোলা হতো না। যেহেতু ক্রেতা জিয়াউর রহমান মোল্লা স্বরূপনগরের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেজন্য বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলা করা হচ্ছে। কিন্তু, এমন কোনও নিয়ম নেই, কোনও রাজনৈতিক নেতাকে জমি বিক্রি করা যাবে না!

এদিকে এদিন তৃণমূলের জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের একটি নির্দেশে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়ল বিরোধী শিবির। সভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেন, দলের যে সব বুথ সভাপতি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, তাঁদেরকে সরিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে বুথ সভাপতি করার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হল স্বরূপনগর উত্তর ব্লকের সভাপতি জিয়াউর রহমান মোল্লাকে। এদিন তিনি সভায় যে সব বুথ সভাপতি হাজির আছেন, তাঁদেরকে হাত তুলতে বলেন। কিন্তু সেখানে বেশ কিছু বুথ সভাপতি গরহাজির রয়েছেন বলে সংশয় প্রকাশ করা হয়। এরপরই জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ বাবু এই নির্দেশ দেন। সূত্রের খবর, এই নিষ্ক্রিয় থাকা বুথ কর্মীরাই তৃণমূলের বিরোধী গোষ্ঠীর সিংহভাগ অংশ। এদিন জেলাসভাপতির এই নির্দেশে কার্যত তাঁরা পদ হারিয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং ব্লকে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়তে চলেছে দলের বিরোধী শিবির।

Related posts

Leave a Comment