কলকাতা, ২৩ মে: চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল শহরের বুকে। নিউটাউনে খুন হলেন বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার। নিউটাউনের একটি অভিজাত আবাসন থেকে উদ্ধার হয়েছে তাঁর দেহ। তিনি বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। আনোয়ারুল সাহেব বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ ও আওয়ামি লিগের কালীগঞ্জ উপজেলার সভাপতি। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে মোট তিনবার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এই হত্যার ঘটনার কথা জানিয়েছেন। এই খুনের ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশ ইতিমধ্যেই তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। কেন এবং কিভাবে এই খুনের ঘটনা ঘটল? ঘটনায় কে কে জড়িত ছিল, তাঁর যৌথ তদন্ত শুরু করেছে দুই বাংলার পুলিশ।
জানা গেছে, সাংসদের সম্পূর্ণ লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ দেহের মূল অংশ ট্রলিতে ভরে পাচার করা হয়েছে, বাকি দেহাবশেষ উদ্ধার করা গেছে৷ এ ঘটনায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য৷ বলা হয়েছে, মোট ছয়জন এ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল৷ তাদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক৷ সাংসদকে হত্যার পর পাঁচজন দেশে ফিরে আসে এবং একজন এখনো ভারতেই অবস্থান করছে৷ তবে বাংলাদেশে ফিরে আসা পাঁচজনের মধ্যে একজন অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে বলেও জানা গেছে৷ আর ভারতে অবস্থান করা ব্যক্তিকে আটক করতে চেষ্টা করছে ভারতের পুলিশ৷
ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আজ জানিয়েছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান৷
পশ্চিমবঙ্গে আনোয়ারুল আজিমের হত্যাকান্ডের খবর নিশ্চিত হওয়ার পর আজ ঢাকায় নিজ বাসভবনে সংবাদ ব্রিফিং করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ এ সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন৷
আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার ঘটনায় তিন আসামিকে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টায় আছি৷ এটা খুন৷ তাঁকে (আনোয়ারুল আজিম) হত্যা করা হয়েছে৷ এখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ কারণ, ভারতের কেউ এখানে জড়িত নন৷ এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমাদের দেশের মানুষই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে কলকাতার এক বাসায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে৷ খুনের উদ্দেশ্য, কারা খুন করেছে, এসব জানতে ভারতের পুলিশ কাজ করছে৷
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, তা তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না৷ তদন্ত শেষ হলে জানানো হবে, তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে৷ মরদেহ এখনো আসেনি৷ দুই দেশের পুলিশ তদন্ত করছে৷ ভারতের পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে তিনি খুন হয়েছেন, এটা নিশ্চিত৷
এ ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত চলছে৷ যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, আমরা পরে সেগুলো প্রকাশ করব৷
আনোয়ারুল আজিম ১২ মে চিকিৎসার জন্য দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান৷ ১৬ মে থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন৷ মূলত নিখোঁজের অভিযোগ পাওয়ার পর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ৷ আটক হওয়া ওই দুই ব্যক্তি সম্প্রতি কলকাতা থেকে ফিরেছেন৷ আটক হওয়া দুজনের মধ্যে একজনের নাম আমানুল্লাহ৷
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার রাতে বলেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একটি দল কেরানীগঞ্জ থেকে শুরুতে আমানুল্লাহ নামের একজনকে আটক করে৷ পরে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যগুলো ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালে তারা জানায় যে আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন৷
জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুজন জানান, লাশ আছে সঞ্জিভা গার্ডেনে৷ সে খবর দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে৷ পরে আজ বুধবার এই লাশ উদ্ধার করে ভারতের পুলিশ৷
আরও জানা গেছে, যে ফ্ল্যাট থেকে আনোয়ারুল আজিম আনারের খন্ডবিখন্ড লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার মালিকও একজন বাংলাদেশি৷ তিনি ভারতে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ওই ফ্ল্যাট কিনেছেন৷ কলকাতার পুলিশ তাকেও খুঁজছে বলে জানানো হয়েছে৷
কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেছেন, ক্যাব চালক স্বীকারোক্তি দিয়েছে ১৩ মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে৷
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে৷ সেখানে কাউকে এখনো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷
পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে৷ তাদের মধ্যে একজন নারী৷ তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি৷
আজ সকালে রাজধানীর বাড্ডায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আনোয়ারুল আজিমের ঘটনায় বাংলাদেশের পুলিশ কলকাতার পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে৷ তারা যোগাযোগ রাখছে৷ কোনো অগ্রগতি থাকলে জানানো হবে৷
পূর্ববর্তী খবরে বলা হয়, পুলিশ সূত্র জানায়, ভারতে গিয়ে ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল কলকাতায় তাঁর পূর্বপরিচিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন৷ গোপালের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে৷ ১৩ মে বেলা ২টার (কলকাতার স্থানীয় সময়) দিকে আনোয়ারুল চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন৷ তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন৷ এরপর আর বাসায় না ফেরার কারণে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন৷
গোপাল বিশ্বাস জিডিতে উল্লেখ করেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছর ধরে পারিবারিক সম্পর্ক৷ ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল আজিম কলকাতার মন্ডলপাড়া লেনে তাঁর (গোপাল বিশ্বাস) বাড়িতে আসেন৷ তিনি কলকাতায় আসেন ডাক্তার দেখাতে৷ পরদিন ১৩ মে স্থানীয় সময় (কলকাতা) বেলা পৌনে ২টার দিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বের হন আনোয়ারুল আজিম৷ যাওয়ার সময় তিনি (আনোয়ারুল) বলে যান, দুপুরে খাবেন না৷ সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন৷ পরে তিনি কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে এসে নিজেই গাড়ি ডেকে চলে যান৷
বাংলাদেশি সাংসদ আনোয়ারুল আজিম খুনে সামনে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে খুন করে হাড়, মাংস আলাদা করা হয়েছিল। তাতে মাখানো হয়েছিল হলুদ। যাতে দেহ পাচারে সুবিধা হয়। লোকে ভাবে খাওয়ার মাংস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাড়হিম এই ঘটনার দাবি করলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত নগরপাল (গোয়েন্দা) হারুন আর রশিদ।
next post