বিশেষ সংবাদদাতা, ফলতা: প্রায় ৩৫০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার মালা গ্রামের দেব সরকার বাড়ি। পলাশীর যুদ্ধের প্রাকালে মালার দেবসরকার বংশের উত্থান ঘটে।
আনুমানিক ৩৫০ বছর আগে বিহারীলাল দেব ব্যবসায়িক সূত্রে ফলতার মালা গ্রামে আসেন। তিনি ছিলেন কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়িক পরিবারের সদস্য। তিনি মালা নিবাসী নাগ বংশের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং মালা গ্রামেই নিজ বসতি নির্মাণ করেন। তৎকালীন সময়ে কলিকাতা থেকে দক্ষিণ বঙ্গের সুন্দরবনের লাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। গাঙ্গেয় জমিতে ধানের সুফলের জন্য ফলতায় বিশাল ধানের আড়ৎ ছিল। এবং ধান ব্যবসার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এই অঞ্চল।
বিহারীলাল দেব নিজে প্রতিষ্ঠা করেন কুলদেবতা শ্রীশ্রী লক্ষ্মীজনার্দন জিউর মন্দির। পরে ব্যবসা এবং জমিদারি বৃদ্ধির পর বিহারীলাল দেবের পুত্র কালিকৃষ্ণ দেব বাংলার ১১৫২ সালে প্রথম এই অঞ্চলে দুর্গা পূজার প্রচলন করেন। পরে প্রজাদের মৈত্রী এবং মিলনের জন্য বাংলার নববর্ষের সময় গোষ্ঠ মেলার প্রচলন করেন।
পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ”সরকার” উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করেন। তখন থেকে এলাকায় দেব সরকার নামে পরিচিত হয় এই পরিবার। এই দেব সরকার বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় আমন্ত্রিত থাকতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা। দুর্গা মঞ্চের সামনে সুবিশাল আটচালা নির্মাণ করা হয়েছিল। আর সেই আট চালাতে দুর্গাপূজোর সময় সাত দিনব্যাপী যাত্রাপালা ও কবিগান হতো। মহিলাদের মনোরঞ্জনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকত ভেতর মহলে। স্বদেশী আন্দোলনের সময়কালে দেব সরকার বাড়ির দুর্গা পুজোতে চারণ কবি মুকুন্দ দাস কবি গান গেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে স্বদেশে আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এই দেব সরকার বাড়ি। জমিদারি প্রথা আর নেই। এখন বড় রাজপ্রাসাদের গায়ে জমেছে আগাছার জঙ্গল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে দেব সরকার বাড়ির ঠাকুর দালানের এক অংশ। অতীতের সেই ঐতিহ্য এখনও পর্যন্ত ধরে রেখেছেন দেব সরকার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। জৌলুসে ভাটা পড়লেও এখনো সেই রীতিনীতি বহাল রয়েছে। দেব সরকার বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ২৭৯ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে।
প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন প্রাচীন কাঠামোর উপর ‘কাঠামো পূজা’ করা হয়। এখানে প্রতিমা এক চালার উপর হয়। একটি সুপ্রাচীন বেল গাছে দেবীর বোধন হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত ১৩১ কিলোগ্রাম চালের নৈবেদ্য হয়। মল্লিকপুরের চক্রবর্ত্তী পরিবার এই দেব সরকার বংশের কুলপুরহিত। কিন্তু পরবর্তীকালে, বেলসিংহার মৈত্র পরিবার এই পূজার পৌরহিত্য করেন। বর্তমানে, মৃৎ শিল্পী শ্রীকান্ত চিত্রকর বংশ পরম্পরায় এখানে মূর্তি নির্মাণ করেন। আর ঢুলিদাররা বংশ পরম্পরায় চাঁদপালার অদূরে সন্তোষপুর থেকে আসেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ এই দুর্গোৎসবের আনন্দ আস্বাদন করতেন।দুর্গাপূজার দিনগুলোতে দেব সরকার বংশের সমস্ত পরিবার পরিজন দেশ বিদেশ থেকে মালা গ্রামে আসেন। পূজার ক’দিনের জন্য।
এ বিষয়ে দেব সরকার বাড়ির এক সদস্য তাপস কুমার দেব সরকার বলেন, জমিদারি প্রথা আর নেই। আর্থিক সংকটের মধ্যে পুজোর জৌলুসে ভাটা পড়েছে। আগে যে পরিমাণ চালের নৈবেদ্য করা হতো এখন আর সেই পরিমাণ নৈবেদ্য। এখনো বলিদান প্রথা রয়েছে কিন্তু আগের মতন পুজোর চার দিন বলিদান করা হয় না। বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা এই পূজার হাল ধরেছে। নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকে পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের অন্যতম মহিলা সদস্য স্মৃতি রেখা দেব সরকার জানান, পুজোর চারটে দিন আমরা চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটাই।নৈবেদ্য থেকে শুরু করে পূজোর অন্যান্য কাজে পুরুষদের পাশাপাশি পরিবারের মহিলা সদস্যরা হাত লাগায়। পরিবারের যে সকল সদস্যরা দেশে বা বিদেশে রয়েছে সে সকল সদস্যরা পুজোর দিনগুলিতে তারা এই দেশের বাড়িতে ফিরে। প্রচুর আনন্দে আমরা এই পূজাকে উপভোগ করি। বিশেষ করে দশমীর দিন সিঁদুর খেলা।
ঐতিহ্যবাহী দেব সরকার বাড়ি স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে। দেব সরকার বাড়ির প্রাচীন সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা এগিয়ে এসেছে।
previous post
next post