সংবাদ কলকাতা, ৮ আগস্ট: প্রয়াত হলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দীর্ঘ রোগভোগের পর বৃহস্পতিবার পাম এভিনিউ-এর বাসভবনে প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এদিকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আকস্মিক প্রয়াণে আমি মর্মাহত। বিগত কয়েক দশক ধরেই আমি তাঁকে চিনতাম এবং গত কয়েক বছরে তিনি যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন আমি কয়েকবার তাঁকে বাড়িতে দেখতে গিয়েছি। এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত দু:খিত বোধ করছি। এই শোকের সময়ে মীরাদি এবং সুচেতনের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই। সিপিআই(এম) দলের সকল সদস্য-সদস্যা, সমর্থক এবং তাঁর সমস্ত অনুগামীদেরও আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ উত্তর কলকাতায় এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত, পুরোহিত এবং একজন প্রখ্যাত লেখক। তিনি পুরোহিত দর্পণ নামে একটি পুরোহিত ম্যানুয়াল রচনা করেছিলেন, যা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু পুরোহিতদের কাছে জনপ্রিয়। বুদ্ধদেবের পিতা নেপালচন্দ্র পৌরোহিত্য না করে পারিবারিক প্রকাশনা সারস্বত লাইব্রেরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যা হিন্দু ধর্মীয় সামগ্রী বিক্রির জন্য নিবেদিত ছিল। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর পিতার মামাতো ভাই। শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাংলাদেশে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং বাংলা (সম্মান) বিষয়ে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এবং একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের চলমান বেকার সমস্যার সমাধান ও রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা করেন। তিনি ব্যবসা সংক্রান্ত তাঁর অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত নীতির জন্য পরিচিত ছিলেন। কারণ সিপিআইএম-এর আর্থিক নীতিগুলি মূলত পুঁজিবাদ বিরোধী ছিল। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর মেয়াদকালে শক্তিশালী জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদ এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগের মুখোমুখি হন। এর ফলে তিনি ২০১১ সালের নির্বাচনে হেরে যান।
উল্লেখ্য, জ্যোতি বসুর ২৩ বছরের শাসনের পর বাম জমানার শেষ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি প্রায় ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০১১ সাল অবধি তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথমে তাঁকে উপ মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। পরে ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ২০০১ ও ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুলভাবে জয় লাভ করে তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখেন। কিন্তু ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদ ও সিঙ্গুর আন্দোলনের জেরে রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ওঠে। মমতার নেতৃত্বে সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানান রাজ্যের সিংহভাগ কৃষক সমাজ ও সাধারণ মানুষ। ফলে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর সরকারের পতন ঘটে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে রাজ্যের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী ও পুলিশ মন্ত্রী ছিলেন।
বুদ্ধবাবু প্রথম জীবনে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তাল খাদ্য আন্দোলনের সাথে সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। পরে তিনি গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক হন। যা পরবর্তীকালে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৭ সালে তিনি কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের প্রফুল্ল কান্তি ঘোষ-এর কাছে ৭৮২ ভোট পরাজিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্র পরিবর্তন করে যাদবপুরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই কেন্দ্র থেকে তিনি টানা ৫ বার জয়ী হন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি এই কেন্দ্র থেকেই সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মণীশ গুপ্তের কাছে পরাজিত হন। তিনি সি. পি. আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, সি. পি. আই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সি. পি. আই (এম) পলিটব্যুরোর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৭-৮২ : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এই বিভাগ পরে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ নামে পরিচিত হয়
১৯৮৭-৯৬ : ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, স্থানীয় শাসন, পৌর ও নগরোন্নয়ন বিভাগ
১৯৯১-৯৩ : ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পুর ও নগর উন্নয়ন বিভাগ (অগ্নি নির্বাপণ পরিষেবা বাদে)
১৯৯৪ : ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ
১৯৯৬ : ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র (আরক্ষা) বিভাগ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ
১৯৯৯ : উপ-মুখ্যমন্ত্রী
নভেম্বর ৬, ২০০০ : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন
মে ১৯, ২০১১ : পঞ্চদশ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করেন
next post