শ্রী সৌম্যদীপ ব্যানার্জী: ১৯০৯ সাল। সারা বাংলা জুড়ে তখন অগ্নিযুগের আগুন জ্বলছে! আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে। স্বাধীনতা চাই, স্বাধীনতা! এই সময়ে কলকাতায় চলছে একটি হাই প্রোফাইল কেস…
শহরেরই মুরারিপুকুরের একটি বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কয়েকজন যুবককে, তাঁরা বিপ্লবী। তাঁদের নিয়েই আলিপুর আদালতে চলছিল শুনানি।
ওই বিপ্লবীদের মধ্যে একজন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। তিনি ছাড়া পেয়ে যান। বাকি যারা ছিলেন, তাঁদের কারও ফাঁসি, কারও দ্বীপান্তরের সাজা হয়। ১৯০৯ সালের ওই বিচারসভায় এই দলেরই একজনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করা হয়। যাঁকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হল, তিনি নির্বিকার চিত্তে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঠগড়ায়। বিচারকের সামনে একটি অনুরোধ রাখলেন, কী সেই অনুরোধ? গান গাওয়ার। অনুমতি মিলতেই গলা ছেড়ে গাইলেন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। ভরা আদালতকক্ষে তাঁর আশ্রয় হলেন রবি ঠাকুর। গাইতে লাগলেন, “সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে।”
গান-টান গাওয়ার পর বেশ খুশি মনেই জেলে ফিরে এলেন তিনি। যেন বেশ মজার একটা ব্যাপার ঘটেছে। এটা মনে করেই হাসতে লাগলেন তিনি। একসময় বলেও ফেললেন, “দায় থেকে বাঁচা গেল।” এমন অবস্থা দেখে ইংরেজ প্রহরী ও অফিসাররা তো তাজ্জব! আজ বাদে কাল যাঁর ফাঁসি হবে, সে কিনা খিলখিল করে হাসছে। যিনি হাসছেন, তিনি বাংলার অগ্নিযুগের ইতিহাসের প্রাতঃস্মরণীয় এক মহাবীর বিপ্লবী। তাঁর নাম উল্লাসকর দত্ত।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই এপ্রিল উল্লাসকর দত্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালীকচ্ছ গ্রামের এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পণ্ডিত দ্বিজদাস দত্তগুপ্ত ছিলেন বিখ্যাত এক শিক্ষাবিদ তথা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। তাঁর মা মুক্তকেশী দেবী ছিলেন স্বামী আনন্দচন্দ্র নন্দীর কন্যা। উল্লাসকরের সমস্ত পরিবারই যুক্ত ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে।
১৯০৩ সালে কলকাতা থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন উল্লাসকর। এই সময়েই ঋষি অরবিন্দ এবং বারীন ঘোষের সাথে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেন তিনি। সাদা চামড়ার অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল। যিনি সম্পর্কে তাঁর মামাতো ভাই বীরেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর শ্বশুর। এই সময়ে বিপিন পালের ছোট কন্যা লীলার প্রেমে পড়েন উল্লাসকর।
প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক রাসেলের অপমানজনক কথা শুনে তাঁকে পিটিয়ে বহিষ্কৃত হলেন উল্লাসকর। বম্বে চলে গেলেন লেখাপড়া করতে। কিন্তু তাঁর মনে ততদিনে বসে গেছে ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোর ভাবনা। বম্বে ছেড়ে চলে এলেন কলকাতা। বিলিতি পোশাক ছেড়ে ধুতি, চাদর পরা শুরু করলেন। রসায়নে তাঁর অসীম দক্ষতা এবং বাবার বই পড়ে বোমা তৈরির পরিকল্পনা করলেন। ইতিমধ্যে হেমচন্দ্র কানুনগো বিদেশ থেকে বোমা তৈরি শিখে এসেছেন। উল্লাসকর ও হেমচন্দ্র একসাথে বোমা বানালেন ১৯০৭-এ।
কুখ্যাত কিংসফোর্ডকে বধ করতে গিয়ে ঘটলো গণ্ডগোল। প্রফুল্ল চাকী আত্মহনন করলেন। ফাঁসি হলো ক্ষুদিরামের। এরপর শুরু হল প্রবল ধরপাকড়। মুরারিপুকুর থেকে ধরা পড়লেন অরবিন্দ, বারীন্দ্র, উল্লাসকর, হেমচন্দ্র সবাই। শুরু হল আলিপুর বোমা মামলা। অরবিন্দ ঘোষ ছাড়া পেয়ে গেলেও ফাঁসির আদেশ হল উল্লাসকরের। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে আপিল করতে অস্বীকার করলেও পরে মামা মহেন্দ্র নন্দীর অনুরোধে তিনি আপিলে সই করেন। ফলস্বরূপ ফাঁসি রদ হয়ে হল দ্বীপান্তর।
আন্দামানে উল্লাসকরের ওপর শুরু হল চরম অত্যাচার। ইতিহাসের পাতায় তাঁর দ্বীপান্তরিত জীবনের যা বর্ণনা আছে, তা শুনলে গা শিউরে ওঠে। আন্দামানের সেলুলার জেলকে এমনি এমনি ‘কালাপানি’ বলা হত না। লোকমুখে সেখানকার বন্দি বিপ্লবীদের অবস্থা ছড়িয়ে পড়েছিল নানা জায়গায়। উল্লাসকর সেই অবস্থা ভোগ করলেন। প্রথমত, অমানুষিক খাটুনি। তার সঙ্গে অকথ্য অত্যাচার, শাস্তি— তাঁর জীবনকে নরক করে দেওয়া হয়েছিল এক প্রকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশ্রাম না দিয়ে ঘানি টানানো, গাছ কেটে লাকড়ি বানানো, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজ চলত। একটু দাঁড়িয়ে পড়লেই মোটা মোটা লাঠি, চাবুক দিয়ে পেটানো আরম্ভ হত। তাতেও না হলে, দু’হাত বেঁধে টেনে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। তারপর চলত আরও নির্যাতন। সমস্ত অত্যাচারই উল্লাসকরকে পোহাতে হয়েছে। মানুষের শরীর ও মন একটা সময় পর্যন্ত সহ্য করে সব। তারপর ভাঙতে আরম্ভ করে। উল্লাসকরের ক্ষেত্রেও তাই হল। ইটের গোলায় কাজ করতে করতে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আর কাজ করতে চাইলেন না। ডাক্তারও তাঁর অবস্থা দেখে চিন্তিত হল।
কিন্তু ইংরেজরা তা শুনবে কেন? ওই অবস্থায় আবার উল্লাসকরকে পাঠানো হল ইটের গোলায়। শেষে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। তারপর, সামান্য ভাতের মাড় খাইয়ে, সারারাত দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ডাক্তারের চেষ্টায় যখন জ্বর, শরীর খারাপ কমল, তখন উল্লাসকরের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন অন্য বিপ্লবীরা। শরীর ঠিক হলেও, মন একদম ভেঙে গিয়েছিল। সেই হাসিখুশি উল্লাসকর জড় পদার্থে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন।
অত্যাচার এখানেও শেষ হয়নি। জেলের হাসপাতালে থাকাকালীন, একাধিকবার জোরালো ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর নিজের বর্ণনায়, ‘‘সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করিয়া, সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া ঐ তড়িৎ নির্গত হইতে থাকে।” একসময় পাগল হয়ে যান তিনি। মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের। ১৯১৪ সালে আন্দামান থেকে মাদ্রাজের মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই বাকি চিকিৎসা করা হয় তাঁর। অর্ধোন্মাদ অবস্থায় ১৯২০ সালে ছাড়া পেলেন উল্লাসকর। শরীর ও মন ভেঙে পড়েছে ভয়ানকভাবে।
দেশের বাড়ি কালীকচ্ছে ফিরলেন উল্লাসকর। কালীকচ্ছে আসার পর তাকে প্রতি সপ্তাহে একদিন সরাইল থানায় হাজিরা দিতে হয়। নিজের তৈরি নৌকাতে ভেসে বেড়ান নদীতে। জন্মশিল্পী উল্লাসকর বাঁশি আর দোতারা বাজান। লোকে তন্ময় হয়ে শোনে। যে হাতে বোমা বানাতেন, সেই হাতেই উঠতো সুরের ঝংকার! গ্রামের ছেলেরা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে তার কারাজীবনের কাহিনী শুনতে। অনুরোধ আসে কারাজীবনের ঘটনা নিয়ে বই লেখার। লিখে ফেলেন ‘কারাজীবনী’। সরাইল থানায় হাজিরা দেওয়া থেকে রেহাই পেয়ে ১৯৩০ সালের দিকে উল্লাসকর দত্ত কালীকচ্ছ থেকে কলকাতায় যান।
কলকাতায় থাকাকালীন জানতে পারেন, তাঁর যৌবনের প্রেম লীলা বিধবা হয়েছেন। একদিন যে লীলাকে অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেন এবং লীলার সামনে আগুন দিয়ে তার সব চিঠি পুড়িয়ে ধুতির খুঁটে ছাই বেঁধে চলে এসেছিলেন, সেই লীলাকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ১৯৪৮ সালে ৬৩ বছর বয়সে ব্রাহ্মমতে বিবাহ হলো দুজনের। উল্লাসকর প্রকৃত অর্থেই প্রেমিক ছিলেন। দেশকে ভালোবেসে নিজের সব দিয়ে দিয়েছিলেন। আর যে নারীকে ভালোবাসতেন, তাঁকে একদা ভর্ৎসনা করেও আবার শেষ কঠিন জীবনে আপন করে নিয়েছিলেন।
দারিদ্র্যের কারণে খুবই মানবেতরভাবে তাঁদের জীবন কাটছিল। লীলার প্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া ভাতাই ছিল তাদের চলার অবলম্বন। উল্লাসকর দত্ত সরকারি ভাতা ও সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেন। নেহেরুর দেওয়া “ভিক্ষা”-এ হাত লাগাননি। তিনি দেশ বিভাগকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এই দম্পতি টালিগঞ্জের ট্রাম ডিপোর কাছে ছোট একটি ঘরে থাকতেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের কোনও একসময়ে সমব্যথী দু-একজন বন্ধুর সহযোগিতায় অসুস্থ উল্লাসকর নিজেই পঙ্গু স্ত্রীকে পাঁজকোলা করে স্টিমারযোগে প্রিয় মহানগর কলকাতা ত্যাগ করে শিলচরের উদ্দেশে পাড়ি জমান।
শিলচরে যাওয়ার পর উল্লাসকর জীবিত ছিলেন আরও ১৩-১৪ বছর। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করলেও মহাবিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত একটি কানাকড়িও ভারত সরকার থেকে গ্রহণ করেননি। ১৯৬২ সালে লীলা দেবী মৃত্যুবরণ করেন। শেষদিন অবধি স্ত্রীর সেবা করেছেন উল্লাসকর। চরম একাকিত্বের মাঝে ১৯৬৫ সালের ১৭ মে ৮০ বছর বয়সে ইতিহাসের ট্র্যাজিক মহানায়ক উল্লাসকর দত্তের জীবনাবসান হয়।
আজ মহাবিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর উদ্দেশ্যে শতকোটি নমন জানাই। যাঁদের রক্তে এই দেশ স্বাধীন। তাঁদের যেন আমরা কখনও ভুলে না যাই।
তথ্যসূত্র:
১. অবিভক্ত বাংলার অসম্পূর্ণ বিপ্লব, জয়দুল হোসেন
২. কারাজীবন, উল্লাসকর দত্ত
৩. Calcutta Myths and History, Soumendra Nath Mukherjee
৪. দ্বীপান্তরের কথা, উল্লাসকর দত্ত
previous post