অভিজিৎ হাজরা, হাওড়া: পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ হল জল দূষণ। বর্তমানে পলিথিন, প্লাস্টিক, থার্মোকল-এর ব্যবহার হওয়ায় জল দূষণ ও বায়ু দূষণ বাড়ছে। ২০০২ সালের ১ লা জুলাই থেকে সারা দেশে প্লাস্টিকের একক ব্যবহারযোগ্য কাপ, চামচ, থালা এবং ৩১ শে ডিসেম্বর থেকে ১২০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে কেন্দ্র সরকার। সেই নিষেধাজ্ঞা জারির পর নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে অভিযানে নেমেছিল স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই অভিযান কয়েক মাস দ্রুত গতিতে চলার পর আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়, এরাজ্যে একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, ১২০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে হাওড়া জেলা।
ইন্টার ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ওয়েষ্ট ম্যানেজমেন্ট, এয়ার অ্যান্ড ওয়াটার সংস্থার উদ্যোগে ২০২২ সালের ১ লা জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, দুই ধরণের নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে হাওড়া জেলা। সমীক্ষায় বলা হয়, হাওড়ায় নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকের কাঁটা চামচ, থালা, দাঁত খোঁচানোর কাঠি, থার্মোকলের থালা, বাটি, প্লাস্টিকের গ্লাস, নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার হাওড়ায় ৭৩ শতাংশ। ১২০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ যে নিষিদ্ধ তাও অনেক মানুষ জানে না। মাত্র ৩৯ শতাংশ মানুষ এব্যাপারে সচেতন।
১২০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অন্যান্য জেলার থেকে এগিয়ে হাওড়া জেলা। নিষিদ্ধ ক্যারিব্যাগ হাওড়ায় ব্যবহার হচ্ছে ৮৯ শতাংশ।
হাওড়ার গ্ৰামীণ এলাকায় বিভিন্ন পিকনিক স্পটে, পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পূজা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত থার্মোকল, প্লাস্টিকের বোতল, গ্লাস, ক্যারিব্যাগ সহ বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ ফেলা হয় নদ-নদী, পুকুর, খাল, বিল, ডোবা, নর্দমা বা এই স্থানগুলির ধারের জঙ্গলে। এই সমস্ত দ্রব্যগুলি ঝড়, বৃষ্টিতে গিয়ে পড়ছে পাশ্ববর্তী নদ, নদী, পুকুর, খাল, বিল, ডোবা, নর্দমায়। পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্যগুলি ঐ স্থানগুলিতে পড়ায় যেমন জল দূষিত হচ্ছে, পাশাপাশি নর্দমা বুজে যাচ্ছে। ফলে জল যেমন দূষিত হচ্ছে, এর পাশাপাশি বায়ুও দূষিত হচ্ছে। জল ও বায়ু দূষিত হওয়ায় নানারকম চর্মরোগ, শ্বাস রোগ, পেটের যাবতীয় রোগের শিকার হচ্ছে মানুষজন।
এই অবস্থায় গ্ৰামীণ মানুষজনকে জল ও বায়ু দূষণের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য এগিয়ে এলেন আমতা ১ নং ব্লকের উদং গ্ৰামের পরিবেশ সংগঠন ‘গ্ৰীণ চেন মুভমেন্ট ‘। এই সংগঠনের সদস্যরা দামোদর নদের বক্ষে নৌকায় সারাদিন কাটালেন। দামোদর নদের বক্ষে ভাসমান প্লাস্টিকের বোতল, ক্যারিব্যাগ, পলিথিন, প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিস, থার্মোকল, বর্জ্য সহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস পরিষ্কার করেন।
‘গ্ৰীণ চেন মুভমেন্ট ‘-এর পরিচালক পরিবেশপ্রেমী ও শিক্ষক প্রদীপরঞ্জন রীত বলেন, ‘এর মাধ্যমে জনসাধারণকে আমরা দামোদর নদ এলাকায় পুকুর, খাল, বিল, ডোবা, নর্দমাগুলিকে প্লাস্টিক, পলিথিন, থার্মোকল, বর্জ্য থেকে দূষণমুক্ত রাখার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। দামোদর নদের বক্ষে ভাসমান থাকা অবস্থায় নদের দুই পাড়ের মানুষজনকে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য সচেতনতার বার্তা দেওয়া হয়। দামোদর নদে স্নান, ভূগর্ভস্থ জলের উপর চাপ কমানোর জন্য ও নানারকম দূষণ রোধ করতে আবেদন জানানো হয়।’
জল নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান, এলাকার গ্ৰামের পুকুর, খাল, বিল, ডোবা, নর্দমার জল দূষণ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ, বৃক্ষরোপণ করা হয় ।
দামোদর নদের তীরে উদং কালীমাতা আশ্রম থেকে এই যাত্রা শুরু হয়। যাত্রার সূচনা করেন আশ্রমের মহারাজ এবং ‘ শিক্ষারত্ন ‘ পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার পাত্র। নদীতে ভাসমানকালীন কিছু কিছু জনবহুল ঘাটে ও স্থানে থামা হয় ও পরিবেশ সম্পর্কে বক্তব্য রাখা ও বার্তা দেওয়া হয়। বক্তব্য রাখেন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড.সৌরভ দুয়ারী, অধ্যাপক সৌমেন রায়, পরিবেশপ্রেমী ও শিক্ষক সায়ন দে, শিক্ষক সুজয় মাল, শিক্ষক সমর মন্ডল, শিক্ষক শৌর্যদীপ্ত নস্কর, শিক্ষক সুব্রত পাছাল, পরিবেশ প্রেমী ও শিক্ষক প্রদীপরঞ্জন রীত, পরিবেশ কর্মী কৌশিক নাগ, মৃৎশিল্পী অচিন্ত্য পাল, চিত্রশিল্পী সৌম্যদীপ দাস, বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী অনির্বাণ সেনাপতি প্রমুখ।
দামোদর নদের বক্ষ থেকে প্লাস্টিক, পলিথিন, থার্মোকল, ভাসমান বর্জ্য পদার্থ তোলার দায়িত্ব নেন শুভজিৎ পাল, কৌশিক নাগ প্রমুখ। অধ্যাপক, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক সহ ত্রিশ জন এই দামোদর নদী বক্ষের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার অভিযানে অংশ নেন। পরিবেশ প্রেমী ও শিক্ষক প্রদীপরঞ্জন রীত বলেন, এই অভিযানে ‘দামোদর নদ’এর তীরবর্তী মানুষদের মধ্যে অত্যন্ত আগ্ৰহ লক্ষ্য করা যায়। বহু মানুষজন পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার অঙ্গীকার করেন।
এই কর্মসূচিতে সামিল হন আবালবৃদ্ধবনিতা। জলে ও ডাঙায় সর্বত্র প্রচার চলে। পরিবেশ ক্যুইজ্যের মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার প্রচারও করা হয়।
শিক্ষক শৌর্যদীপ্ত নস্কর বলেন, ‘আমতা শহর ও গ্ৰামীণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের যথেষ্ট অপচয় হচ্ছে। এই বিষয়ে মানুষজনকে সচেতন করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ‘। পরিবেশপ্রেমী ও শিক্ষক সায়ন দে বলেন, ‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডিজের ব্যবহার, শব্দবাজির ব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন ও প্রতিবাদ করার জন্য দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হবে। পরিবেশপ্রেমী ও শিক্ষক প্রদীপরঞ্জন রীত, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. সৌরভ দুয়ারী, বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী অনির্বাণ সেনাপতি বলেন, ‘বন্যপ্রাণী, পাখি, কীটপতঙ্গ রক্ষার করার জন্য মানুষজনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।