মৃন্ময় ভট্টাচার্য
“না খায়েঙ্গে না খানে দেঙ্গে” এই কথাটি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “খাব না, খেতেও দেব না”। আসলে প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে ঘুষ খাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি চাইছেন, এক দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র তৈরী করতে। কিন্তু বিরোধীদের কাজ তাঁর প্রতিটি কথার বিরোধীতা করা। যেমন এক সময় আর এক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন “গরীবী হটাও”, বিরোধীরা তাকেই “গরীব হটাও” বলে প্রচার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীবদের ভোটে সেই প্রধানমন্ত্রীকেই হটিয়ে দিয়েছিলেন।
এবারও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কথাটাকেই তুরুপের তাস করে বিরোধীরা বলছেন, “খাওয়া যেহেতু চার দেওয়ালের মধ্যেই হয়, সেখানে জনগণ বা মিডিয়ার দৃষ্টি পড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি খেলেও তা জানা সহজে সম্ভব নয়। কিন্তু সত্তরোর্ধ যে ব্যক্তির চাকচিক্য হাঁটাচলা নব্য যুবকের মতো, তিনি কিভাবে না খেয়ে থাকতে পারেন! আর মুদ্রাস্ফীতির কারণে যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে রান্নার গ্যাসের, যা প্রতিদিন খাদ্য তৈরীর মূল জ্বালানি। যা দিন দিন গরীব ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে জনগণকে খেতে না দিতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ।
অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগণকে উল্টো বুঝিয়ে ভোট আদায়ের এই প্রচেষ্টা চলে আসছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির গোড়া থেকেই।
আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকেই অনুসরণ করি। তাতে আড়ালে আবডালে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন কটূক্তি করলেও পাত্তা দিই না। আত্মীয় পরিজন বা বন্ধুবান্ধব কারও বাড়িতে গেলে আমি কখনো মিষ্টির প্যাকেট বা অন্যকিছু নিয়ে যাই না। চাই না তারাও ওইরকম কিছু নিয়ে আমার বাড়িতে আসুক। তবে কি জানেন, আমি আমার কথা রাখলেও ওরা কেউই আমার কথা রাখে না। এটা ঘোর কলিকাল। কেউ কথা রাখেনা, তাই আমিও অপমানিত হতে চাইনা বলে, কাউকেই আর আমার মনের ইচ্ছা জানাই না।
এই সেদিন মহাদেববাবু হঠাৎ খুব নামকরা মিষ্টির দোকান থেকে প্রায় এক কেজি লাল মিষ্টি দই, সঙ্গে দুটি প্যাকে ভর্ত্তি বড় বড় সন্দেশ নিয়ে আমার গৃহদ্বারে হাজির। কি আর করা যাবে, আমি হাস্যমুখে তাকে আমন্ত্রণ জানালাম। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞায় আমি অবিচল। তাঁকে মিষ্টিমুখ করার বদলে মুখে কিছু মিষ্টি বাক্য বলে বিদায় জানালাম।
এই মহাদেববাবুর স্বভাব ঠিক আমার বিপরীতে। তিনি খেতেও ভালোবাসেন আবার খাওয়াতেও ভালোবাসেন। আসলে তিনি পুলিশের বড় অফিসার ছিলেন তো, সেই পুরানো অভ্যাস কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেননি।
মহাদেববাবু এখন ভীষণ মানসিক কষ্টে আছেন। এখন তিনি শুধুই খাওয়াতে পারছেন, খেতে পারছেন না। আমার বলাটা একটু ভুল হয়ে গেছে। তিনি শক্ত কিছু আর খেতে পারছেন না। তরল বা সেমি তরল খাচ্ছেন গিলে। তাঁর এই কষ্ট দেখে আমিও কেমন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। ভাবছি আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ভেঙে একদিন ওনার বাড়ি গিয়ে ঘোল খাইয়ে আসব।
খাবার দেখলে উনি নিজেকে আর সামলাতে পারেন না। মিষ্টি ও রাস্তার ধারের ধুলো মাখা, দশবার ব্যবহার করা পোড়া তেলের চপ, সিঙারা ওনার বড় প্রিয়। সুগার আছে, আছে বার দুয়েক মেরামত করা দুর্বল হৃদযন্ত্র। আছে বাড়ির হাইকোর্ট ও ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা। তবু এই পঁচাত্তর বছর বয়সে ছোঁকছোঁকানি তার গেল না। অন্যের মুখে শুনেছি, এই দোষ ওনার যৌবন শুরুর সময় থেকেই ছিল। তবে খাদ্যের প্রতি নয়, অন্য এমন কিছুর প্রতি, যা এখানে বলা ঠিক হবে না।
ওনার খেতে না পারার মূল কারণ দন্ত বিপর্যয়। শহরের বেশ কয়েজন চপ শিল্পী ও মিষ্টান্ন বিক্রেতা, উনি এই দন্ত বিপর্যয় থেকে যাতে দ্রুত মুক্তি পান তার জন্য তাঁদের গণেশ ঠাকুরের কাছে মানত করেছেন। আসলে ওনার দাঁতের অবক্ষয়ের কারণে ওনাদের গণেশ উল্টে যাওয়ার ভয় ধরেছে। শুনেছি মহাদেববাবুর পারিবারিক দাঁত দেখানোর এক নির্দিষ্ট দন্ত বিশারদ আছেন। প্রায়শই পরিবারের সকলের দাঁত তোলাতে ওই ডাক্তারের কাছেই যান। ডাক্তারবাবু ইনস্টলমেন্টে দাঁত তোলার অর্থ নেন। তাই মহাদেববাবুর পরিবারে কারও ক্ষমতা নেই খিঁচিয়ে বত্রিশপাটি দেখাবার। মহাদেববাবুর অনেকগুলো দাঁতই তার আগেই বৈকুন্ঠে পৌঁছে গেছে। এবার কষের দুটো দাঁতে ব্ল্যাকহোল তৈরী হয়েছে। যা খেতে যাচ্ছেন সবই পেটে না গিয়ে ব্ল্যাকহোলের তীব্র টানে কোথায় যে চলে যাচ্ছে, তা তিনি ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনী কিছুতেই ঠাওর করতে পারছেন না। তাদের দন্ত বিশারদ ডাক্তারবাবু দন্ত বিকশিত করে বলেছেন কোনও ভয় নেই। এবার আর দাঁত তুলব না। রুটক্যানাল করে দেব। যাতে আপনার খাওয়ার কোনও অসুবিধা না থাকে। তবে ইনস্টলমেন্টটা কিছুটা বাড়াতে হবে।
আসলে ডাক্তারবাবু ভয় পেয়েছেন এইরকম রসালো খদ্দেরের সব দাঁত যদি ফুরিয়ে যায়, তাঁর গণেশও……..।
ঘোল খাওয়াতে গিয়ে দেখলাম মহাদেববাবুর মুখে সেই পুরানো দিনের হাসি আবার ফিরে এসেছে। ওনার সাথে চপ শিল্পীরা, মিষ্টান্ন বিক্রেতার সহ দন্ত বিশারদ ডাক্তারবাবু সবাই ভীষণ খুশি। হার্ট স্পেশালিস্ট ডাক্তারবাবুও তৃতীয়বার হৃদয় মেরামত করার জন্য দিন গুণছেন। এই খবর শুনে শুধু আমারই হৃদয়বিদারক অবস্থা। মহাদেববাবুর দাঁতের জন্যই তো আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে গেল। উল্টে আমিই যে ঘোল খেয়ে গেলাম!
previous post