April 7, 2025
রাজ্য

ধর্মতলা ও ধর্মঠাকুরের ইতিহাস বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান কাল

জ্যোতিষ্মান সরকার: মঙ্গলকাব্য ছাড়া গ্রাম বাঙলার সংস্কৃতি কল্পনাতীত। বাঙলার চার শ্রেণীর জাতীয় মঙ্গলকাব্য

– রাঢ় – ধর্মমঙ্গল
– বঙ্গ – রায়মঙ্গল
– পুন্ড্র – গোসানীমঙ্গল
– বরেন্দ্র – মনসামঙ্গল

এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ময়ুরভঞ্জে রসিক মঙ্গল পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খন্ডের পাকুড়ে গৌরী মঙ্গল ও আরও অনেক অসংখ্য অঞ্চল ভিত্তিক মঙ্গলকাব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গলকে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলা হয়।

চন্দ্রকোণার তিপ্পান্ন গলির অন্তত তিপ্পান্নটি ধর্মঠাকুর আজও কয়েকটি মন্দিরের ভিতর থেকে বোধহয় খুঁজে বের করা যায়। ধর্ম সংস্কৃতির কেন্দ্র সম্ভবত ছিল উড়িষ্যার যাযপুর। এখনও মিদনাপুরের গড়বেতা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ধর্ম পূজা চলত।

প্রাচীন পঞ্চরত্ন দেবালয়ে ধর্মঠাকুর সহ তিনি বিরাজমান। মন্দিরের গায়ে লিপিটি নিম্নরূপ –

“প্রতিষ্ঠিতমিদং শাকে পক্ষাব্জবসুচন্দ্রমে
রাধাক্ষয়তৃতীয়ায়াম্ দিঙমানেকুব্জবাসরে
(১২৯০ সাল, ১০ই বৈশাখ)”

এর ঠিক বামদিকে আরেকটি ভগ্নলিপি আছে। তাতে লেখা আছে –
“কলকলি পদং ধ্যাত্বা তস্যা
গৃহমিদম্ … তাম্বুলি”


প্রায় ১২০-২২ বছর আগে, কোনও এক তাম্বুলিবণিক মন্দিরটি কলকলি ধর্মকামিন্যার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের মধ্যে বিরাট কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর আছেন। চন্দ্রকোণায় যত ধর্মঠাকুর দেখা যায়, তার সবই কূর্মমূর্তি এবং এত জীবন্ত মূর্তি যে মনে হয় পাথরের নয়, রক্তমাংসের। তবে কেবলমাত্র চন্দ্রকোণায় নয়, পূর্বে ধর্মঠাকুরের যে প্রতিপত্তি কেন্দ্রের কথা আগে বলা হয়েছে, তার সর্বত্রই যেসব ধর্মঠাকুরের মূর্তি দেখা যায়, তার অধিকাংশই কূর্মমূর্তি। চন্দ্রকোণা, জাড়া, রামজীবনপুর, ঘাটাল, গোঘাট প্রভৃতি অঞ্চলে এত সুন্দর নিখুঁত সব বড় বড় কূর্মমূর্তি আছে, যা ভাষ্কর্যের নিদর্শন হিসেবেও উল্লেখযোগ্য।

বৈদিক দেবতা ইন্দ্র বা বরুণের রূপ হিসেবে: অধ্যাপক ক্ষিতিশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “দাক্ষিণাত্যে, ধর্মরাজ হলেন যুধিষ্ঠির ।” বসন্ত রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় (জাল) ময়ূরভট্টের ধর্মমঙ্গলের ভূমিকায় লিখেছেন, “শতপথ ব্রাহ্মণের যুগে “ধর্ম” শব্দ ব্যক্তিত্ববাচক এবং দেবতাবাচক হইয়াছে। ধর্মদেবতার আসন দেবগণের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত। কৃষিপ্রধান আর্যগণের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্র। সেই ইন্দ্র দেবতা ধর্ম দেবতায় বিলীন হইলেন। ইনি আবার জলদেবতারূপে পরিকল্পিত হইয়াছেন। শতপথ ব্রাহ্মণে জল বা বৃষ্টি জলকেই ধর্ম বলিয়া প্রচার করা হইয়াছে।

অপর এক ধর্ম ব্রহ্মার দক্ষিণ বক্ষ হইতে উদ্ভূত। ইঁহার তিন পুত্র শম, কাম ও হর্ষ। পৌরাণিক যুগে ধর্ম বহুস্থানে বহু অর্থে ব্যক্তিত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। … অন্যত্র ধর্ম প্রজাপতি এবং দক্ষ জামাতা। অপর এক ধর্ম ঘৃত নামক পুত্রের পিতা এবং অণু নামক পিতার সন্তান। আর এক ধর্ম হৈহয় বংশীয় নেত্রের পিতা। বিছরও ধর্মপুত্র। ইহা ছাড়া বহু স্থানে ধর্ম নামক ব্যক্তির উল্লেখ আছে।… মহাভারতের উদ্যোগপর্বে আর এক অজ্ঞাত ধর্মদেবতাকে দেখিতে পাই। এই ধর্ম- দেবতার সহিত গালব ঋষির সম্পর্ক আছে।

আবার অনেকে কূর্মমূর্তি দেখে ধর্মকে বরুণ হিসেবেও কল্পনা করেন। ধর্মমঙ্গলের হরিশ্চন্দ্র পালার ধর্মদেবতা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কথিত শুনঃশেফ কাহিনীর বরুণদেবতার সঙ্গে অভিন্ন।

কৃষি সভ্যতার মানুষের বস্তুতান্ত্রিক ভাবনার কথাও এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে ।ধর্মঠাকুর একাধারে শস্য তথা বৃষ্টিপাতের উদ্দেশ্যে পুজিত দেবতা এবং কতকগুলি যাদুবিশ্বাসের ভিতর দিয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের রূপলাভ করেছেন।

যম ও ধর্ম : ধর্মঠাকুরের সঙ্গে যমরাজা কম সম্পর্কশূন্য নন। মহাভারতে ধমকে ধর্মরাজ বলা হয়েছে। ধর্মঠাকুর ও মনসার সম্পর্কে ঋগ্বেদের যম-যমীর প্রভাব আছে। ধর্মের সঙ্গে যমের সম্পর্ক প্রসঙ্গে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্তও আলোচনা করেছেন। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন, “শ্রীযুক্ত নলিনাক্ষ্য দত্ত সম্পাদিত গিলগিট পুঁথিতে (ষষ্ঠ শতাব্দী ) পাই ‘ধর্মস্য ধর্ম- রাজন্য’ ‘যমোঽপি ধর্মরাজ’। ধর্মরাজ নামের সুত্র এবং তাঁর গ্রাম দেবত্বের ইঙ্গিত রয়েছে, ঋগ্বেদের একছত্রে। ধর্ম হয়েছেন গ্রামবাসীর রাজা। ‘ধর্মাভূবদ বৃজন্য রাজা’ *

রাঢ় অঞ্চলে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে দেখা যায় বহু জায়গায় (যেমন সিউড়ী থানায়, ইন্দ্রগাছা, ছোড়া, ভগবানবাটি, সাঁইথিয়া থানায়, অজয়কোপা; বোলপুর থানায়, সুপুর, মীর্জাপুর, রজতপুর এবং বর্ধমানে রামচন্দ্রপুর গ্রামে) ধর্মঠাকুরকে যমের ধ্যানে, যমদেবতা মনে করে পুজা করা হয়।

রাঢ় অঞ্চলের যেকোন লোক দেবতাকেই ধর্ম ঠাকুরের রূপ হিসেবে কল্পনা করা হয় । এর কারণ কি সেভাবে জানা যায় না। বিশেষত রাঢ় অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীই কোন না কোনভাবে ধর্ম ঠাকুরকে মানে।বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোমরা প্রধানত এই পুজা করে থাকেন । তবে সদগোপ মাহিষ্য কৈবর্ত গোয়ালা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বড় অংশের মধ্যে কুলদেবতা হিসেবে ধর্ম ঠাকুরের স্থান আছে।

নাগ উপাসনায় ধর্ম: গোড়ার দিকে মনসামঙ্গলের কাহিনী ধর্মকাহিনীর সঙ্গে অভিন্ন (মনসাই ধর্মের কামিনী)। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন। তাতে পাওয়া যায় যে, শিব মনসাকে সিজুয়া পর্বতে ফেলে রেখে আসবার সময়ে ‘ধামাই’কে সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর রক্ষক ও বাহন রূপে। ধামাই হলেন ধর্ম ও তিনি একটি সাপ। পরে হয়েছেন ‘ঢেমনা’ বা ‘ঢেরা সাপ’। এখানে মিল পাওয়া যাচ্ছে, বাসুকির উপরে বসুমতী = ধামাইয়ের উপরে মনসা। পুরাণে বর্ণিত কৃষ্লীলায় পাওয়া যায় যে, অক্রূর যখন কৃষ্ণবলরামকে বৃন্দাবন থেকে মথুরায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন যমুনার তীরে রথ রেখে তিনি যমুনার হ্রদে ডুব দিয়েছিলেন নাগরাজ শেষকে দর্শন ও বন্দনা করতে। হরিবংশে নাগ রাজাকে বলা হয়েছে ধর্মদেব, তিনি শুভ্র ও তিনি ধর্মাসনগত। নাগরূপী ধর্মদেবতার এক পরিণতি বাস্তুদেবতায়।

ধর্মমঙ্গল – ধর্মমঙ্গল অনুসারে ময়নাগড়ের রাজা লাউসেন কোঙার ছিলেন ধর্ম ঠাকুরের উপাসক। তিনি রাজা দ্বিতীয় মহিপালের সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি তার সেনাপতি কালু ডোমকে সঙ্গে নিয়ে ঢেকুর গড়ের অপরাজে গোপ রাজা ( পূর্বতন বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্ত শাসক) ইছাই/ ঈশ্বর ঘোষ কে পরাজিত করেন।ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণিত হলেও বহুধাবিত্তৃত এবং বৈচিত্র্যময় কাহিনীই এর প্রধান আকর্ষণ। দেবী পার্বতীর প্রসাদে সােম ঘােষের পুত্র ইছাই ঘােষ গৌড়েশ্বরের( মহীপাল ২য়) সামন্তরাজ কর্ণসেনকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করলে গৌড়েশ্বর সহানুভূতিবশতঃ কর্ণসেনের সঙ্গে আপন শ্যালিকা রঞ্জাবতীর বিয়ে দিলেন। ধর্মঠাকুরের অনুগ্রহে এদের দুটি পুত্র হয়-লাউসেন ও কপূরসেন। এই লাউসেনের বিচিত্র কাহিনীই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান উপজীব্য। ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে বহু অসাধ্য সাধন করেছেন। এই প্রধান কাহিনীটি ব্যতীতও ধর্মমঙ্গল কাব্যে সদাডােম এবং হরিশ্চন্দ্র রােহিতাশ্বের (লুইধর) দুইটি উপকাহিনী যুক্ত হয়েছে।এতে কংস-কৃষ্ণ কাহিনী এবং রামায়ণের যুদ্ধ ও মায়ামুণ্ডের কাহিনী স্পষ্টতঃই যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। লাউসেনের ভ্রাতা কপূরসেনের চরিত্রে লক্ষ্মণ ও কুশের প্রভাব এবং কালুডােমের পত্নী লখাই-চরিত্রে মহাভারতের বিদুলা- চরিত্রের প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে।

ঐতিহাসিকগণ রূপরাম চক্রবর্তীকেই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতম কবি বলে মনে করেন। তিনি তার কাব্যে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তাতে জানা যায় তার পিতার নাম শ্রীরাম চক্রবর্তী, মাতা দময়ন্তী বা দৈবস্তীনিবাস ছিল বর্ধমান জেলার শ্রীরামপুর গ্রাম। কবি তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতার হাতে অনেক নির্যাতন ভােগ করেছেন। গ্রন্থেৎপত্তির কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন যে একদা এক বাঘ দেখে তিনি পুকুরপাড়ে গেলে সেখানে স্বয়ং ধর্মঠাকুর তাকে দেখা দিয়ে বলেন—

আমি ধর্মঠাকুর বাঁকুড়া রায় নাম।
বার দিনের গীত গাও শােন রূপরাম।


রূপরাম গােয়ালভূমির (গোপভূমের) রাজা গণেশের আশ্রয় লাভ করে সেখানেই গীত রচনা করেন। রূপরামের এই গ্রন্থের রচনাকালরূপে একটি শ্লোক রচনা করা হয়েছে—

শাক সীমে জড় হৈলে যত শাক হয়।
চারিবাণ তিন যুগে ভেদে যত রয়।।
রসের উপরে রস তাহে রস দেহ।
এই শােকে গীত হৈল লেখা করা লহ।


এ থেকে সন তারিখ বের করা দুষ্কর হলেও উদ্যোগী পুরুষগণ এ থেকে একাধিক তারিখ উদ্ধার করেছেন, সেটি ১৫৯০ খ্রীঃ সম্ভবত গোপভূমের সদগোপ রাজারা ধর্মপুজাকে রাজ্যের রাস্ট্রীয় ধর্ম করেছিলেন। আজও মেদিনীপুরের সদগোপদের একটা বড় অংশের মধ্যে বাঁকুড়া রায়ের পুজা করে থাকেন। এমনকি আমার পরিবারেরও কূল দেবতা বাঁকুড়া রায়।

ধর্মপুরাণ অনুযায়ী সৃষ্টিতত্ত্ব: ধর্ম ঠাকুরের উৎস কোথায় তা সঠিকভাবে অনুমান করা যায় না কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অজীবক সিদ্ধাচার্য, বজ্রযাণী বৌদ্ধ , নাথশৈব, সৌর পন্থার মিশ্রণ ঘটেছে। তবে ডক্টর অমলেন্দু মিত্র তাঁর লেখা রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্ম ঠাকুর গ্রন্থে এর উৎস সন্ধানের প্রয়াস করেছেন।- প্রাগৈতিহাসিক যুগে কৃষিকাজ-সংক্রান্ত বিশ্বাস এই ধারণার আদি উৎস।

শূন্য-পুরাণের মােট একান্নটি অধ্যায়ের মধ্যে পাঁচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। অবশিষ্ট অধ্যায়গুলিতে বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। মহাযানপন্থী বৌদ্ধ এবং নাথপন্থী শৈবদের প্রভাব বিশেষভাবেই লক্ষ্য করা যায় শূন্যপুরাণে এবং ধর্মমঙ্গল কাব্যের সৃষ্টিতত্ত্বে। কীভাবে নিরঞ্জন ধর্ম, আদ্যাশক্তি, কাম এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু-শিবাদির উদ্ভব ঘটলাে তা এই সৃষ্টিতত্ত্বে বর্ণিত হয়েছে। দেবতা আদিত্য ধর্মের পূজা প্রচার করবার জন্য রামাই পণ্ডিতরূপে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মমঙ্গল কাব্যের হরিশ্চন্দ্রের পালা এবং সদাডােমের পালায় রামাই পণ্ডিতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

ব্রহ্ম বা শূণ্য মূর্তিতে ধর্ম: ধর্ম শূন্যমূর্তি দেবতা অর্থাৎ যাঁর কোন মূর্তি নেই। তিনি ব্রহ্ম-অণ্ড ভেদ করে উদ্ভূত হয়েছিলেন এবং তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অসীম জলরাশির মধ্যে ত্রিকোণ পৃথিবী এবং ত্রিদেব – ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর – সৃষ্টি করে শূন্যে বিলীন হয়েছিলেন অর্থাৎ মারা গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্য পুরাণের ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা – অর্থাৎ বৃহৎ অণ্ড ভেঙে বিশ্বের উৎপত্তি – ধর্মঠাকুরের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। ঋগ্বেদের সূক্তে (১০/১২৯) ‘তুচ্ছ’ অর্থাৎ কিছু না থেকে ডিমের আবির্ভাব এবং সে ডিমের দু’দিক থেকে – স্বধা ও প্রযতি – তা দেওয়ার উল্লেখ আছে। ডিম ভেঙে কি বেরলো, তার কোন স্পষ্ট বর্ণনা কোথাও নেই – না বৈদিক সাহিত্যে, না ব্রাহ্মণ্য পুরাণে, না ধর্মের কাহিনীতে। তবে এদিক ওদিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কিছুটা নির্ভরযোগ্য অনুমান খাড়া করা যায়। ধর্মকাহিনীর সৃষ্টি বর্ণনা থেকে মনে হয় যে তিনি ছিলেন সাপ। জলে ভাসতে ভাসতে হাই তোলেন। তার থেকে উলুক পাখির সৃষ্টি হয়। সেই পাখি হয় তাঁর বাহন। সেই বাহনে চড়ে উড়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে শেষে তিনি পৃথিবীর সৃষ্টি করেন।

এখানে ব্রাহ্মণ্য পুরাণের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায় – কুর্মের উপরে বাসুকি বা শেষনাগ, তার মাথায় পৃথিবী।

অনেকের শূন্য পূরাণকে ব্যবহার করে ধর্মকে বৌদ্ধদেবতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।ধর্মঠাকুর যে বৌদ্ধ দেবতা নন তা আধুনিক পণ্ডিতবর্গ মত প্রকাশ করেছেন। ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “Dharma who is however described as the supreme deity, creater and ordainer of the Universe, superior even toBrahma, Vishnu and Siva and at times identified with them and he hasnothing of the abstraction of the Buddhist Dharma about him”

সৌর উপাসনায় সূর্যের রূপ: ধর্মঠাকুর শুভ্র নিরঞ্জন।পুরোনো লোকদের বিশ্বাস সূর্যের রং সাদা এবং তার বাহন ঘোড়ায় টানা রথ। এ থেকে সূর্যের প্রতীক ধর্মকেও মনে করা হয় শুভ্র এবং তাঁর পূজার সময় তাঁকে কাঠের ঘোড়ায় চড়ানো হয়।

ধর্ম ঠাকুরের থানে ঘোড়া দেওয়ার প্রচলন রয়েছে যে কারণে মনে করা হয় ধর্মের বহন ঘোড়া ।চৈত্র মাসের সংক্রাস্তিতে আরম্ভ করে বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত বাঙ্গালীর ধর্মঘট ব্রত করার বিধান আছে। প্রতিদিন এক একটি জলপূর্ণ ঘট ব্রতকারিণী রমণী ব্রাহ্মণকে দান করে থাকেন।

সূর্যের চারিদিকে নানা রঙের যে চক্র সৃষ্টি হয়ে থাকে তার নাম ধর্মসভা। কারণ সূর্যকে ধর্ম মনে করা হয়। আই এটিকে অনেকে সৌর উপাসনার রূপ হিসেবেও কল্পনা করেন। সদ্য ধর্মান্তরিত (৪/৫) প্রজন্ম মুসলিমদের মধ্যেও মাজারে ঘোড়া দেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে কয়েক দশকে ওয়াহাবি ভাব ধারার প্রভাবে মুসলিম সমাজ এই হিন্দুয়ানী রীতি ত্যাগ করেছেন।ধর্মঠাকুরের পূজা পদ্ধতি ও বর্ণনা দেখলে তাঁকে মহাদেব এবং সূর্যদেবের সংমিশ্রণ বলা চলে।

ঘোড়ার অস্তিত্ব ভারতবর্ষে খুব পুরনো নয় বলে একটি গোষ্ঠীর পন্ডিত বর্গ মতামত দিতেন । সেই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে সিনৌলির খনষ কার্য থেকে।

আর্যভাবনায় ঘোড়া নিয়ে যে সকল কৃত্য আছে তা এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন উচ্চৈঃশ্রব।-অশ্বের কথা সুবিদিত। সূর্যের সপ্তাশ্ব বাহিত রথও সুপরিচিত তথ্য। সুর্যমন্দির গাত্রে সূর্যমূর্তির পাদদেশে ঘোড়ার মূর্তি খোদাই-এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমরা পেয়েছি। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে ( ৭-৭৭-৩ ) সূর্যকেই অশ্বরূপে বর্ণন। করা হয়েছে। ( ধর্মঠাকুরকে সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখানো হয়ে থাকে সে কথা স্মর্তব্য ) আবার বিষ্ণুর নব্বইটি ঘোড়া। তার প্রত্যেকের চারিটি করে ভিন্ন ভিন্ন নাম। শ্রীবিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য “বৈদিক দেবতা” পুস্তিকায় বলেছেন, “এর দ্বারা সম্ভবতঃ বৎসরের তিনশ ষাট দিন ও চারটি প্রধান ঋতুকে বোঝানো হয়েছে।” পৌরাণিক যুগের অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা আমরা জানি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ( অধ্যক্ষ প্রচার অধ্যায় ) অশ্বের নিয়মিত স্নান, গন্ধমালা প্রদান, কৃষ্ণপক্ষে ভূতবলি, শুক্লপক্ষে স্বস্তিবাচন এবং আশ্বিন মাসের নবম দিনে নীরাজনা ও আরত্রিকের ব্যবস্থা আছে। এই সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে আর্যভাবনায় অশ্ব একটি বিশিষ্ট মর্যাদার স্থান অধিকার করেছিল ।

শিবরূপে ধর্ম: ধর্মঠাকুরো কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিব রুপে পূজিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হুগলি হাওড়ার ঘন্টাকর্ণ ( ঘেঁটু) পূজাকেও শিব ও ধর্মের মিলিত রুপ বলা হয় । মেদিনীপুর বাঁকুড়া অঞ্চলে কূর্ম মূর্তিতে বাঁকুড়া রায়ের পুজা হয়। অনেকে বাঁকুড়া রায়কে ধর্মঠাকুরের রুপ বলেন।

অধ্যাপক বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের অনুসরণে বলতে গেলে – “এরা পরবর্তীতে বৌদ্ধ বজ্রযান ও শৈবধর্মের মিশ্রণোদ্ভূত শৈবনাথপন্থী। এ অঞ্চলে বহু নাথ যোগীরা বাস করেন। ধর্মঠাকুর ছিলেন তাঁদের আরাধ্য দেবতা।

বিনয় ঘোষ এর পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি থেকে জানা যায় থেকে জানা যায় বর্ধমান অঞ্চলের বহু শিবলিঙ্গ কূর্ম আকৃতির।”

মুর্শিদাবাদের কান্দি বীরভূম বর্ধমান এমনকি বাঁকুড়াতে ফতে সিং নামে এক পূজা চলে। তাকেও অনেকে ধর্ম ঠাকুরের রূপ হিসেবে মনে করেন।গ্রামদেবতা ধর্মঠাকুর স্থান ভেদে বিভিন্ন নাম গ্রহণ করে থাকেন, যথা- যাত্রাসিদ্ধি রায়, কালু রায়, বুড়া রায়, দলু রায়, জগৎ রায় প্রভৃতি।

পূজার নিয়ম – ধর্মপূজা সাধারণত তিন প্রকারে অনুষ্ঠিত হয়: নিত্য, বারমতি এবং বাৎসরিক। নিত্যপূজা অনাড়ম্বর; তবে ঠাকুরের কৃপালাভে ধন্য ভক্তরা কিছুটা আড়ম্বরসহ তাঁর পূজা দিয়ে থাকে। বারমতি পূজা যেকোনো রবিবার (অঞ্চলভেদে শনি বা মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ পূজায় সাদা রঙের পাঁঠা বা পায়রা বলি দেওয়ার রীতি আছে। বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতি অনুসারে আজ থেকে ৫০ বছর আগে বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে মুসলিমরাও পাঁঠা মানত করত। মানত পূজা সার্বজনীন এবং তা বিখ্যাত কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়—এই বিশেষ আড়ম্বরপূর্ণ পূজার নাম ‘গৃহভরণ’ বা ‘ঘর ভরা’। একটি অঞ্চলের ১২টি স্থানে পূজিত ১২টি ধর্মশিলা বা ধর্মঠাকুরের প্রতীক কেন্দ্রীয় স্থানে স্থাপন করা হয় এবং ১২ দিন ব্যাপী এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মপূজায় কতকগুলি পারিভাষিক নাম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নিরাকার ব্রহ্মের স্ত্রীরূপে কল্পিত শিলাখণ্ডকে বলা হয় ‘কামিন্যা’, ধর্মের সেবায়েতের নাম ‘দেয়াসী’ (দেবদাসী), দেয়াসীর প্রধান সহায়ক ধামাকনী (ধর্মাধিকারিণী?), বলির পশুর নাম ‘লুয়ে’, আর বার দিন গাইবার উপযােগী পালাগানকে বলা হয় ‘বারমতি’।

এজন্য কোনো বাৎসরিক পূজা সমারোহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এ পূজায় বহু কৃত্য ও বিধিবিধান পালিত হয়। বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত বৈশাখী পূর্ণিমায়। কোনো কোনো স্থানে চৈত্র বা জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায়ও অনুষ্ঠিত হয়। এ পূজাকে ‘দেল’ বা দেহারা বা ‘দেউল পূজা’ও বলে। এ উপলক্ষে কোথাও কোথাও ধর্মঠাকুরের  গাজন হয়।ধর্মঠাকুরের পূজা পদ্ধতি ও বর্ণনা দেখলে তাঁকে মহাদেব এবং সূর্যদেবের সংমিশ্রণ বলা চলে।

ধর্মঠাকুরের উৎসবকে বলা হয় “ধর্মের গাজন”। ধর্মের গাজন ও শিবের গাজন সমরূপ। তবে ধর্মের গাজনে ঘোড়ার ব্যবহার আবশ্যক, যা শিবের গাজনে নেই। গাজনের সন্ন্যাসীদের “ভক্ত” বা “ভক্তিয়া” বলা হয়। তারা এমন কতকগুলি অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন, যা অন্ত্যেষ্টী সৎকার প্রথার অনুরূপ। মনে করা হয়, গাজন ধর্মঠাকুর ও দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব। কিন্তু এই ধারণায় কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে সদ্য মৃতের মস্তক নিয়ে নাচেনো উল্লেখ রয়েছে, যা শিবের গাজনে হয় না।

তবে শিবপুজার ভারতব্যাপী প্রসারতা, প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্য আলোচনা কল অনুমান করা যায় ধর্মঠাকুরের চেয়ে শিবই প্রাচীন দেবতা।

রাঢ় অঞ্চলে সংগৃহীত তথ্য থেকে ধর্মঠাকুরের শিবসাযুজ্য বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করছি। প্রথম শিবসাযুজ্য হল শক্তিকে কামিনীরূপে গ্রহণ—সিঙ্গুর গ্রামে ধর্মপুজার পর বাণগোঁসাইকে এক বৎসরের মত গ্রামের একটি শিবালয়ে যাওয়া হয়। এখানে ভাঁড়াল নড়ানোর সময় যে শ্লোক বলা হয়, তার একটি লাইন উল্লেখযোগ্য : “উত্তরে মৌলপুরে যে বাবা শিব আছেন তাঁর শ্রীচরণে প্রণাম”। কচুজোড় গ্রামে কালীমন্দিরে ধর্মরাজ ও ভৈরব এবং একটি শিবমন্দিরের পাশে বটবৃক্ষের নীচে একজন ধর্মরাজ ও ভৈরব আছেন। এখানে বলি হয় না। শিবচতুর্দশীর দিন শিবের উদ্দেশে যখন তেল পোড়ানো হয় তখন ধর্মরাজ ও ভৈরব পূজা পান। তা ছাড়া কচুজোড়ের মূল ধর্মরাজ জ্যৈষ্ঠ-পূর্ণিমায় তাঁর গ্রাম-পরিক্রমার সময় এঁদের সংগে সাক্ষাৎ করে যান। কচুজোড়ে লটাতলা নামে একটি জায়গায় অপ্রকাশিত ধর্মরাজ আছেন বলে কথিত হয়। সেখানেও একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সম্প্রতি গ্রামের উত্তরবর্তী সংগ্রামপুরের এক ব্রাহ্মণ নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাজরাজেশ্বরী কালীর নিকটে যে ভৈরব আছেন তিনি ধর্মপুজার সময় বুড়ো রায়ের নিকট যান ।

ভুরকুনা গ্রামে ধর্মের সঙ্গেই আছেন ভৈরবনাথ। পামুড়ের ধর্মমন্দিরে শিব ও ভৈরব আাছেন। কোদাইপুর গ্রামে শিব আছেন ধর্মশিলার বামে। কামালপুর ধর্মতলায় ভৈরব ও ধর্মরাজের সঙ্গে যুক্তভাবে অপর একজন ভৈরব আছেন। গোলাপগঞ্জে ধর্মরাজের সঙ্গে আছেন ভৈরবনাথ। লাউজোড়েও তাই। ঐ গ্রামে জ্যৈষ্ঠ-পুর্ণিমায় ধর্মের গাজনে কোনো ভক্ত্যা হয় না। চৈত্র মাসে শিবের গাজনের ভক্ত্যারা ধর্মরাজের সামনে এসে গান গাইতে গাইতে ডর নামে।

বাংলার নাযপন্থী যোগীদের কোনো কোনো অনুষ্ঠানে ধর্মপুজার কিছু কিছু প্রক্রিয়া গৃহীত হয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন লিখেছেন : “শিবের নীলাবতীর সঙ্গে ধর্মের নীল অনিলের এবং অথর্ববেদের ব্রাত্য স্বক্তাবলীর নীল-লোহিতের ও মাতরিশ্বাপবমানের তুলনা করা যায় ।” “ধর্মপুঞ্জাবিধানে” স্থাপন-ডাকে ধর্মঠাকুরকে আহ্বান করার রীতি আছে। যথা— “কৈলাস ছাড়িয়া গোসাঞি করহ গমন”।”

প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ধর্মরাজের সঙ্গে বহু জায়গায় শিব অভিন্ন হয়ে গেছেন। ১৮১৫ সালে ওয়ার্ড সাহেব ধর্মপুজাকে দ্বিতীয় প্রকার শিবপুজা বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের গুপ্তাড়ী ও রায়কালী নামে দুটি গ্রামের ধর্মরাজের গাজন ও চড়কের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: “Another form of Shiva. A black stone of any shape be- comes the representative of this God. The worshippers paint the part designated as the forehead and place it under a tree; others place the stone in the house and give it silver eyes, and anoint it with oil and worship it. Almost every village has one of these idols.

ধর্মপুরাণ:‌ কিছুকাল পূর্বে বিশ্বভারতী থেকে ড. পঞ্চানন মণ্ডলের সম্পাদনায় আর একখানি নতুন ধর্মমঙ্গল কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। কবির নাম যদুনাথ বা যাদবনাথ। মনে হয় ইনি হাওড়া জেলার লোক, কারণ পুঁথিটি হাওড়া জেলার একটি গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে। সৌভাগ্যের বিষয় পুঁথিটি অখণ্ডিত ও সম্পূর্ণ।।কাব্যের মধ্যে কবি নিজের সম্বন্ধে যে যৎসামান্য ইঙ্গিত দিয়েছেন তা থেকে দেখা যাচ্ছে, শোভা সিং নামে এক বিদ্রোহী দুর্দান্ত জমিদার বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরামকে নিহত করে

কবি রাজা কৃষ্ণরামের সেই হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করে বলেছেন, “সেইকালে গীত সাঙ্গ হইল আমার।” ১৬৯৬ খ্রীঃ অব্দে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।   সুতরাং দেখা যাচ্ছে যদুনাথ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধর্ম মঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন। অবশ্য নিজের কাব্যকে কবি সর্বত্র ‘আগমপুরাণ’ বলেছেন।

কবি ধর্মঠাকুরের মহিমা লিখতে বসলেও বৈষ্ণব ও শাক্তমতের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। খুব সংযত ও মার্জিত ভাষায় রচিত ‘আগমপুরাণে’ কবি শুধু রামাই পণ্ডিত ও হরিশচন্দ্র-লুইচন্দ্রের কাহিনী বলেছেন, লাউসেনের কোনো উল্লেখ করেননি।

কাহিনীতে হরিশ্চন্দ্রের প্রথম দিকে ধর্ম বিরোধিতা, পরে শক্তির আরাধনা করে ধর্মের কৃপায় পুত্রলাভের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এবং তার পরের গল্প অন্যান্য ধর্মপুরাণ বা আগমপুরাণের মতো। কাহিনীটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ় থেকে ধর্মঠাকুরের পূজা ভাগীরথীর পূর্বতীরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কলকাতা পর্যন্ত যে প্রচলিত হয়েছিল, তা আজও বোঝা যায়। দক্ষিণে প্রাচীন আদিগঙ্গার তীর ধরে আজও ধর্মের ‘যাত’ হয়। কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর সোনারপুরের বাজারে ডোমপণ্ডিত পূজা করেন এখনও। বর্তমান হাজরা রোড ও শরৎ বসু রোডের (পূর্বতন ল্যান্সডাউন রোড) মোড়ে একটি প্রাচীন ধর্মঠাকুরের মন্দির আছে, এখন শিবই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছেন। কসবা, বেহালা প্রভৃতি অঞ্চলেও ধর্মঠাকুর আছেন। পূর্বোক্ত সিমস সাহেবের রিপোর্টে দেখা যায় যে, একশো বছর আগে লালবাজার-রাধাবাজার অঞ্চলে ৩১,৬৮০ বর্গফুট জুড়ে বেশ একটি ‘ডোমতালা’ ছিল। ধর্মতলার পিছনে ছিল ‘হাড়িপাড়া লেন’। পশ্চিমবঙ্গের (রাঢ়ের) ধর্মঠাকুরের বিখ্যাত সেবক বা পণ্ডিত ডোম ও হাড়িজাতির বেশ প্রাধান্য ছিল ধর্মতলা অঞ্চলে দেড়শো বছর আগেও। যেখানে হাড়ি ও ডোমের এরকম প্রাধান্য ছিল, সেখানে কোনো ধর্মঠাকুর ছিল না একথা মনে হয় না। গ্রামাঞ্চলে এখনো ডোমপন্ডিতদের পৌরহিত্যের রীতি আছে । সারা কলকাতায় ধর্মঠাকুরের একসময়ে বেশ প্রতিপত্তি ছিল এবং তাঁর গাজনও হত।

লেখক বিটেক সেরামিক টেকনোলজির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
(তথ্যসূত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন – সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)

Related posts

Leave a Comment