মৃন্ময় ভট্টাচার্য
সেই তিন মাস ছিল আমার ও আমার বন্ধুদের কাছে বড় সুখের। ছিলনা পড়াশোনার চাপ, ছিল অফুরন্ত সময়, এক সাথে আড্ডা দেওয়া আর অজানাকে জানার তীব্র তৃষ্ণায় দল বেঁধে অভিযানে বেরিয়ে পড়া।
সবার বয়স ষোলোর আশেপাশে, কারো মুখে গোঁফের হাল্কা রেখা, কেউ তা না ওঠায় ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত । মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আমরা পাঁচ বন্ধু ঠিক করলাম, ঐতিহাসিক শহর মুর্শিদাবাদ বেড়াতে যাবো। রমাপ্রসাদ যাকে আমরা রমা বলে ডাকি, সে এসব ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে ছিল ওস্তাদ। ওর নেতৃত্বেই আমরা এতদিন আমাদের শহরের প্রতিটি অজানা অলিগলি জয় করে বেজায় আনন্দে দিন কাটাচ্ছি, তখন নিজেদের এডমান্ড হিলারির থেকে কোনো অংশে কম মনে হতো না। ওনার সঙ্গে তফাৎ ছিল একটাই, ওনার পথ ছিল ভার্টিকাল আর আমাদের হরিজন্টাল, বাকি সব তো একই!
কিন্তু মুর্শিদাবাদ তো মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ের দৈর্ঘ্যে অনেক বেশী যা আমাদের কাছে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার সমান, তাই বড় একজন কেউ সঙ্গে না গেলে বাবা-মা কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন ।
পটলডাঙার ক্যাবলা, হাবুল, প্যালারামের যেমন গাইড ছিল টেনিদা। তেমনই প্রদীপ তার পাশের বাড়ির রবিদাকে আমাদের গাইড হিসাবে জোগাড় করে ফেললো। ওদিকে রমাপ্রসাদ আরও এক খুশির খবর নিয়ে এলো। ওর বন্ধু সতীশের পৈতৃক বাড়ি পলাশীতে, একেবারে ফাঁকা বাড়ি। সতীশ আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি, ওর বাড়িতে উঠলে আমাদের থাকা খাওয়ার খরচ লাগবেনা নিশ্চয়ই , সঙ্গে সেই প্রসিদ্ধ আমবাগান, যেখানে লর্ড ক্লাইভ ও সিরাজদৌল্লার যে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়েছিল সেটাও এইতালে দেখা হয়ে যাবে।
মোট সাতজনের টিম নিয়ে আমরা রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদ অভিযানে। প্রত্যেকের কাছেই একশো- দেড়শো টাকা করে আছে, যা সে যুগে যথেষ্টই। আমি আমার টাকা থেকে খরচটুকু পকেটে রেখে বাকীটা দুভাগে দুটো গোপন স্থানে রেখেছি। বন্ধু ভোলানাথ আবার তার পায়ের মোজার মধ্যে মা লক্ষ্মীকে এমনভাবে লুকিয়েছে, যাতে অসুর কোনোভাবেই তাঁকে লাঞ্ছিত করতে না পারে।
নৈহাটী থেকে দুপুরের লালগোলা প্যসেঞ্জার ধরে সন্ধ্যায় পলাশী পৌঁছনোর পরিকল্পনা। হুগলীঘাট ষ্টেশনে আমরা সাত মক্কেল যথাসময়ে হাজির হলাম। টিকিট কাটার পালা, আমাদের গাইড রবিদা আদেশ দিলেন দশটাকা করে ছ'জনের ষাট টাকা তার কাছে জমা দিতে। আমি আর সতীশ নিজেরাই নিজেদের টিকিট কাটবো বলায় প্রথমেই একটু মনোমালিন্য হলো। বাকিরা টাকা দিলে রবিদা তাদের টিকিট কেটে নিজের কাছেই রেখে দিল।
ব্যান্ডেল-নৈহাটি লোকালে নৈহাটী পৌঁছনোর আধঘন্টা পর আমাদের বহু প্রতীক্ষিত লালগোলা প্যসেঞ্জার এসে গেল। উঠে সবাই সহজেই পছন্দমতো বসার আসন পেয়ে গেলাম, চলছে ইয়ার্কী, ঠাট্টা, একে অন্যকে ক্ষ্যাপানো, যা এই বয়সের বন্ধুদের মধ্যে হয়ে থাকে।
রানাঘাট ষ্টেশন আসতেই চা খাওয়ার পর্ব শুরু হলো, রবিদা ভোলাকে বাধ্য করলো চা-এর দাম মেটাতে। অচিরেই হলো সেই আনন্দঘন মুহূর্তের বিরতি, কারণ হঠাৎ কালো কোট পড়া চার পাঁচ জন টিকিট চেকারের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর উদয়। লক্ষ্য করলাম রবিদার হাস্যজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ শুকিয়ে পানসে হয়ে গেল। গরম চা ভর্তি ভাঁড়টা পাশে বসা এক জীর্ণ দেহাতি মহিলার হাতে ধরিয়ে দিতে ঐ মহিলা ওকে আশীর্বাদ করলেন। রবিদা একছুঁটে বাথরুমে ঢুকে, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। হঠাৎই রমা, ভোলা, জয়ন্ত ও প্রদীপ ভীষণ উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো, কারণ ওদের সবার টিকিট আছে রবিদার পকেটে। রবিদা বাথরুমে ঢুকেছে, এবার চেকার এলে হবেটা কি ! আমি আর সতীশ দিব্যি মজা করে ওদের দেখছি, কারণ আমাদের টিকিট আমদের কাছেই আছে, নো দুশ্চিন্তা।
দুই কামরার মধ্যবর্তী যাতায়াতের প্যসেজ দিয়ে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চেকার ও পুলিশরা টিকিট চেক করতে করতে এগিয়ে আসছে আমাদের কামরার দিকে। উৎকন্ঠিত রমা দৌড়ে বাথরুমের দরজায় টোকা মারতে শুরু করেছে, তবু রবিদার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওদের অসহায় অবস্থা।
ট্রেন এগিয়ে চলেছে ঝড়ের গতিতে আর কালো কোট পড়া "মামা"রা আস্তে আস্তে প্রবেশ করলো আমাদের কামরায়, আমার চার বন্ধুর চোখে মুর্শিদাবাদ বাদ হয়ে কারাগারের ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। দম বন্ধ করা পরিবেশ। চেকাররা যখন আমাদের আগে দরজায়, একেবারে কাছে এসে গেছে, তখনই ট্রেন থামলো কৃষ্ণনগর ষ্টেশনে। এ কি কান্ড! যাদের ভয়ে আমার বন্ধুদের এতক্ষণ দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তারা সবাই নেমে গেল কৃষ্ণনগরে! ওফ্ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই আজ ওদের বাঁচিয়ে দিলেন। কিন্তু রবিদা! সে যে এখনও বাথরুমে স্বেচ্ছাবন্দীত্ব কাটাচ্ছে।
আমি ডাকতে গেলাম রবিদাকে, বললাম "রবিদা অল ক্লিয়ার"। তবু রবিদার কোনো সারা নেই। যাব্বাবা, বাথরুমের দুর্গন্ধে অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি!
আমাদের চার সঙ্গীকে দীর্ঘক্ষণ নরক যন্ত্রণা দিয়ে রবিদা ঐ নরক থেকে বহাল তবিয়তে আবির্ভূত হলো আরও একঘন্টা পর, বন্ধু চারজন ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো রবিদার ওপর। চারটে টিকিট আমাদের এখুনি দাও। রবিদা শান্ত, স্পিকটি নট। জোর করে রবিদার পকেট ঘেঁটে উদ্ধার হলো মাত্র একটা টিকিট। বোঝা গেল পুলিশ যদি জোরকরে বাথরুমের দরজা খোলাতো, এই টিকিটটাই জেলের ভাত খাওয়া থেকে রবিদাকে বাঁচাতো। আর এই রবিদারই দৌলতে বাকি চারজনের এই বিদেশ বিভুঁয়ে নতুন মামার বাড়ির কাঁকড় মেশানো বিনি পয়সার ভাত খাওয়া একেবারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ।
পরনির্ভর না হয়ে নিজের কাজ নিজে করো বলে একটা উপদেশ আছে, আমি কোনোকালে কারুর উপদেশ শুনে চলতে অভ্যস্ত নয়, তবে ভাগ্যিস এই সময় নিজের টিকিট নিজে কেটেছিলাম!
পথ অনেক বাকী …..এরপর পলাশীর প্রান্তরে।