শ্রী সৌম্যদীপ ব্যানার্জী: মেদিনীপুরের চেতুয়া বরদা এলাকার রাজা শোভা সিংহ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন ঔরঙ্গজেবের প্রচণ্ড হিন্দু বিরোধী নীতি এবং মোগল পদলেহনকারী দক্ষিণবঙ্গের মোগল সুবেদার বর্ধমান রাজ-এর বিরুদ্ধে।
শোভা সিংহের জন্ম চেতুয়ার এক বর্গক্ষত্রিয় পরিবারে। তাঁর পূর্বপুরুষ রঘুনাথ সিংহ এই অঞ্চলে জমিদারি স্থাপন করেন সম্ভবত বিষ্ণুপুর অঞ্চল থেকে এসে। শোভা সিংহ ছিলেন স্বাধীনচেতা পরাক্রমশালী এক সাহসী নেতা।
দিল্লির মসনদে ঔরঙ্গজেব বসার পর থেকে শুরু হয় ভীষণ অত্যাচার। জিজিয়া কর চাপানো হয়, সুবেদাররা হিন্দু মন্দির ভাঙতে শুরু করে। আর শুরু হয় হিন্দু নারীদের ওপর অত্যাচার।
শোভা ও তাঁর ভাই হিম্মত সিংহ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এইসব দেখে। তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, বর্ধমানের হিন্দু রাজারা হয়তো তাঁদের সাহায্য করবে। কিন্তু মোগল পদলেহনকারী কিশনরাম রাই (কাপুর) কোনও সাহায্য করলেন না। এমনকি শোভা সিংহের আত্মীয়তা স্থাপনের ইচ্ছাও ঘৃণ্য শব্দে প্রত্যাখ্যান করলেন কিশনরাম। ইতিমধ্যে শোভা সিংহের অতি সুন্দরী কিশোরী কন্যা চন্দ্রপ্রভাকে বেগম করার কথা জানায় সুবে বাংলা ঢাকার সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ… দুই ঘটনায় অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন শোভা।
যুদ্ধ ঘোষণা করলেন শোভা সিংহ। যোগ দিলেন অন্যান্য হিন্দু জমিদাররা এবং পাঠান রহিম খাঁ; সরাসরি যুদ্ধে যোগ না দিলেও মল্লরাজ দুর্জন সিংহ মল্ল শোভা সিংহের বিরুদ্ধে না গিয়ে একপ্রকার সাহায্যই করেন। সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে গড় মান্দারন অবধি জয় করলেন শোভা। মান্দারনের অপরদিকে হিন্দু রাজ্য ভুরশুট আক্রমণ করলেন না। এরপর আক্রমণ করলেন বর্ধমান। কিশনরাম তাঁর ছেলে জগৎরামকে পাঠালেন ঢাকায় সাহায্যের জন্য। কিন্তু লাভ হল না। শোভা সিংহের প্রচণ্ড আক্রমণে পতন হল বর্ধমান রাজের। জগতরাম নারীর ছদ্মবেশে পালিয়ে যায়।
সমকালীন ফরাসি নথিপত্র থেকে জানা যায়, ওলন্দাজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয়রা শোভা সিংহকে কর প্রদান করেছিল। ১৫ জানুয়ারি ১৬৯৭ তারিখে ফরাসি পত্রসমূহে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, পুরনারীদের সঙ্গে ভোজ উৎসবে মশগুল অবস্থায় উঁচু চত্বর থেকে পড়ে শোভা সিংহ নিহত হন। শোভা সিংহের মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁর চরিত্র হননের জন্য সত্যবতী নামক রাজকন্যা ও শোভা কর্তৃক তার চরিত্র হননের এক মিথ্যা কাহিনী লেখা হয়েছিল। যদুনাথ সরকারের ন্যায় ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।
শোভা সিংহের মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিমুশ্বান ও ঢাকার সুবেদার ইব্রাহিম এবং তার ছেলে জবরদস্ত খান মিলিতভাবে বিদ্রোহ দমন করতে নামেন। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ১৭০৩ নাগাদ বিদ্রোহ প্রশমিত হয়ে যায়।
ইতিহাস ‘বাংলার শিবাজি’ আখ্যা দিয়েছিল শোভা সিংহকে। তবে কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না শোভা। পানীয় জলের জন্য পুষ্করিণী খনন, সেচ, নিকাশি ও পরিবহণের জন্য নদী-খালের সংস্কার, পথ-ঘাট নির্মাণ ইত্যাদি বহু কাজ করেছিলেন তিনি। শোভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল গ্রামীণ হস্তশিল্পের উন্নয়ন। হস্তশিল্পের পণ্য বিপণনের জন্য কয়েকটি হাট-বাজারের পত্তন করেছিলেন শোভা। তেমনই বড় আকারের একটি বাজার বসিয়েছিলেন রাজধানী বরদার কাছে। নাম করেছিলেন— রানির বাজার। কাঁসার বাসন, সুতি ও পাট বস্ত্র, বিশেষ করে রেশমসামগ্রীর বিপুল বেচা-কেনা হত বাজারে। দ্রুত লোকবসতি গড়ে উঠেছিল বাজারকে কেন্দ্র করে।
শোভা সিংহ মা বিশালাক্ষী র উপাসক ছিলেন। বরদা অঞ্চলে তিনি এক মন্দির স্থাপন করেন, যা আজও আছে। এছাড়াও ঘাটাল অঞ্চলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত শীতলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
শোভা সিংহের মৃত্যুর পর চেতুয়াবরদা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল ইব্রাহিম। কিন্তু রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা ততদিনে মল্লভূমের শাসক মহারাজা রঘুনাথ সিংহ মল্ল দ্বিতীয়-এর প্রেমে পড়েছেন। ইব্রাহিমের আক্রমণের খবর পেয়ে প্রিয়তমাকে রক্ষা করতে আসেন মল্লরাজ। এই খবর পেয়ে ইব্রাহিম আর চেতুয়া বরদা আক্রমণ করার সাহস করেনি। এই সময়েই মল্লরাজের সাথে চন্দ্রপ্রভার বিবাহ হয়।
ছবি:
শোভা সিংহের ফেসবুকে প্রাপ্ত ছবি
শোভা সিংহ প্রতিষ্ঠিত বিশালাক্ষী মন্দির
মা বিশালাক্ষী
ধ্বংসপ্রাপ্ত শীতলা মন্দির
তথ্যসূত্র:
মল্লভূম বিষ্ণুপুর মনোরঞ্জন চন্দ্র
মেদিনীপুরের ইতিহাস প্রথম ভাগ যোগেশচন্দ্র বসু
Early history of Bengal যদুনাথ সরকার
তৎকালীন ইউরোপীয় বিভিন্ন লেখা
next post