সংবাদ কলকাতা: একাধিক আর্থিক দুর্নীতি মামলায় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কৌস্তভ রায়কে গ্রেপ্তার করল ইডি। পিনকন কর্তা মনোরঞ্জন রায়ের টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এব্যাপারে পিনকনের মালিক মনোরঞ্জন রায় নিজেই এই অভিযোগ করেছেন। তাঁর টাকা ফেরত চাইলে কৌস্তভ সেই টাকা দিতে অস্বীকার করে এবং হুমকি দেয়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। পাল্টা সে জানায়, তাঁর চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের জন্য এই টাকা নিয়েছে সে। যদিও সেই বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনও নথি কৌস্তভ দিতে পারেনি। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের একাধিক প্রভাবশালীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর। তাঁর বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালিয়ে হিসাব বহিৰ্ভূত লেনদেনের বহু নথি উদ্ধার করে আয়কর দপ্তর। এজন্য গতকাল সকালে তাঁকে ইডির দপ্তরে তলব করা হয়।
এনফোর্স ডিরেক্টরেটের নোটিস পেয়ে বিকেলে হাজির হন কৌস্তভ রায়। এরপর তাঁকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তাঁর কথায় একাধিক অসঙ্গতি মেলে। তদন্তে সে অসহযোগিতা করতে শুরু করে। শেষে রাত ১ টা নাগাদ গ্রেপ্তার করা হয় কৌস্তভকে। তাঁর একটি মোবাইলের সঙ্গে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির কথোপকথনের হদিশ মিলেছে। সেজন্য সেই মোবাইলটি বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি।
চিটফান্ড মামলায় বেশ কিছুদিন ধরে আয়কর দপ্তর তদন্ত করছিল। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাও এই মামলার তদন্ত চালাচ্ছিল। সেই তদন্তে কৌস্তভের একাধিক ব্যাঙ্ক একাউন্টের হদিশ মেলে। সেই একাউন্টগুলিতে প্রচুর আর্থিক অনিয়মের তথ্য পেয়েছে আয়কর দপ্তর। কিন্তু কৌস্তভ রায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমাকে ইচ্ছে করে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্ত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, অনেক আগেই ওকে গ্রেফতার করা উচিৎ ছিল। ওর কল লিস্টে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের যোগ মিলেছে। ওকে ভালো করে রগড়ালে মমতাও ধরা পড়বেন বলে দাবি করেন।
প্রসঙ্গত আর্থিক দুর্নীতিতে কৌস্তুভ রায় ইডি-র হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মত। দল ও সরকারের সঙ্গে তাঁর ভূমিকা ক্যাবিনেট মিনিস্টার বা হাইভোল্টেজ নেতার মতো। বিভিন্ন সময়ে দল ও সরকারের ড্যামেজ কন্ট্রোলে ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করেছেন। একটা সময় তাঁকে পুলিশের পাইলট কার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টপাধ্যায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর মামলা সংক্রান্ত সব কিছু দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন এই কৌস্তুভ রায়। আবার তিনি তৃণমূলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে হুমকিও দিতে দেখা গেছে। তাঁর ব্যাঙ্ক একাউন্টে হিসাব বহিৰ্ভূত বিপুল টাকার লেনদেনের হদিশ মিলেছে। এহেন কৌস্তুভ রায়ের সঙ্গে তৃণমূলের প্রকৃত সম্পর্ক কী? তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে।
ইডি সূত্রের খবর, মনোরঞ্জনের বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা পিনকনের বিরুদ্ধে বাজার থেকে ৬৩৮ কোটি টাকা সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। আমানতকারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে, ২০১৭ সালে তাঁর এবং কোম্পানির অন্য ডিরেক্টরদের বিরুদ্ধে খেজুরি থানায় কেস রুজু হয়। পরে রাজস্থান পুলিসও মামলা রুজু করে। ইডি ২০২১ সালে তদন্তভার হাতে পায়। তখন তদন্তে দেখা যায়, চিটফান্ড কর্তা ২৫টি কোম্পানি খুলে বাজার থেকে নিয়ম ভেঙে টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে পাঁচটি কোম্পানির সঙ্গে কৌস্তভের কোম্পানির লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই টাকা চিটফান্ড কোম্পানি থেকে কৌস্তভের কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়েছে। চিটফান্ড কর্তা জানান, তাঁর সঙ্গে কৌস্তভের পরিচয় ১৯৯৮ সাল থেকে। ২০১৩ সালে মনোরঞ্জন দেড় কোটি টাকা দেন কৌস্তভকে। নিজের মামলার খরচ, দেনা পরিশোধসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এই টাকা নেন কৌস্তভ। এরপর দফায় দফায় তিনি আরও দেড় কোটি টাকা নেন বলে অভিযোগ। মনোরঞ্জন এই টাকা ফেরত চাইলে কৌস্তভ হুমকি দেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দিক থেকে সে কতটা ক্ষমতাশালী তা বুঝিয়ে দেন। এভাবে কৌস্তভ ওই টাকা ফেরত দেননি বলে অভিযোগ।
ইডির তদন্তে প্রকাশ, কৌস্তভকে আরও ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা বিজ্ঞাপন বাবদ দেন মনোরঞ্জন। কিন্তু পুরোটা ওই কাজে লাগানো যায়নি। এখনও ২ কোটির বেশি টাকা ফেরত পাবেন মনোরঞ্জন। এমনকী, মনোরঞ্জন নগদেও আরও কিছু টাকা কৌস্তভকে দেন। ইডি অভিযোগ পেয়েছে, মনোরঞ্জন রায়ের কালো টাকা পাচারে কৌস্তভ বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। গভীর রাতে গ্রেপ্তারের পর আজ তাঁকে আদালতে তোলা হয়। পাশাপাশি তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়। আদালত কৌস্তভকে ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে।
previous post