সুভাষ পাল: মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোট প্রচারের চরম মুহূর্তে বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয় বর্গীয়কে নিয়ে সরব হলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। তথাগতবাবু কৈলাশকে ভোডাফোনের প্রচার বিজ্ঞাপনের সেই কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে সমাজ মাধ্যমে একটি ছবিও পোস্ট করেছেন। সেই ছবির ক্যাপশনে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে,”ভোডাফোন আবার পশ্চিমবঙ্গে”! তথাগতবাবু তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, “যে ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে অর্থ ও নারীর সংস্কৃতি রোপণ করেছেন, তিনি দৃশ্যত ইন্দোরে জয়গান গাইতে চাইছেন…’ইয়ে বন্ধন তো প্যায়ার কা বন্ধন হ্যায়’! পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে অবশ্যই এর অবশিষ্টাংশের শেষ ফোঁটা থেকে পরিষ্কার করতে হবে। এবং আমি কুকুর বলতে চাই না।”
প্রসঙ্গত, এবার মধ্যপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা ভোটের প্রচার কার্যক্রম তুঙ্গে। এরই মধ্যে সেখানে বিধানসভা ভোটের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। ইন্দোরের ১ নম্বর আসনে কৈলাশ বিজয় বর্গীয়কে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে বিজেপি। কিন্তু, ইন্দোরের ৩ নম্বর আসনের প্রার্থী হিসেবে কৈলাশের পুত্র আকাশের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, এমনিতেই কৈলাশ এই বয়সে প্রার্থী হওয়ার ঝক্কি নিতে চাইছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলে আকাশকে প্রার্থী করতে। কিন্তু দল সেবিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, যে বিধায়ক (আকাশ) ব্যাট দিয়ে সরকারি অফিসারকে মারধর করে গ্রেপ্তার হন, তাঁকে কোনওভাবেই টিকিট দেবে না দল। অবশেষে কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্বের অনমনীয় মনোভাব দেখেই কৈলাসকে নামতে হয়েছে নির্বাচনী যুদ্ধে।
সূত্রের খবর, এবার এই আসনে জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। তবুও কৈলাশ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ‘করণ-অর্জুন’ ছবির গানের কলি, ‘ইয়ে বন্ধন তো প্যায়ার কা বন্ধন হ্যায়’ গেয়ে উঠছেন। আর সেটা নিয়েই কটাক্ষ করেছেন তথাগত রায়। তাঁর অভিযোগ, যে ব্যক্তি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে পশ্চিমবঙ্গে নারী আর অর্থের কারবার করেছেন, তাঁর প্রতি বিন্দু কলঙ্ক থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে মুক্ত হতে হবে।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে টিকিট বন্টন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। দলের যোগ্য ব্যক্তিরা টিকিট না পেয়ে অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্তরা অনায়াসে বিধানসভার টিকিট পেয়ে যায়। এমনকি দলের ২০ বছরের পুরনো রাজ্য নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে তৃণমূল থেকে আসা দুর্নীতিগ্রস্ত নব্য বিজেপি নেতাদের মধ্যে টাকার বিনিময়ে দেদার টিকিট বন্টনের অভিযোগ ওঠে। এই নীতি মূলত সংগঠন আগ্রাসী তৃণমূলের সঙ্গে জোট রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর গৃহীত নীতি।
অর্থাৎ বাজপেয়ী জমানায় তৃণমূল যখন বিজেপি-র সঙ্গে এনডিএ জোটে ছিল, তখন এরাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিজেপির টিকিটে জয়ী পঞ্চায়েত সদস্য ও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরা টাকার বিনিময়ে রাতারাতি রং পাল্টে তৃণমূলের দলে ভিড়ে যেত। তাঁদের অধিকাংশই বিজেপিতে নবাগত ছিল। যেহেতু তৃণমূল এনডিএ জোটের শরিক ছিল, সেজন্য রাজ্য বিজেপি-র নেতারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। পরবর্তীকালে তৃণমূল এনডিএ-এর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তৎকালীন রাজ্য বিজেপি দলীয় স্তরে একটা অলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, নতুন যাঁরা দলে আসবে, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ভোটে লড়ার জন্য টিকিট দেওয়া হবে না। কিন্তু, গত বিধানসভা ভোটে কৈলাশ বিজয় বর্গীয় ও মুকুল রায়ের দাপটে সেই সমীকরণ পুরো পাল্টে যায়। নবাগতদের টিকিট দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। সূত্রের খবর, দলের প্রকৃত আত্ম উৎসর্গকারী নেতাদের বঞ্চিত করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে দুর্নীতিগ্রস্তদের কাছে দলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে।
যার ফলে দীর্ঘদিন এরাজ্যে গেরুয়া সংগঠন গড়ার জন্য যাঁরা আত্মত্যাগ করে আসছেন, তাঁদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। গত বিধানসভা ভোটে অনেক আঞ্চলিক নেতা রাজনীতি থেকে বসে গিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের দেখাদেখি দলের দীর্ঘদিনের কর্মী ও সমর্থকরাও হাত গুটিয়ে নেন। রাজ্যের মানুষের কাছে বিজেপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। দলের আদর্শ ও নীতি নিয়ে নতুন সমর্থকদের মধ্যেও সংশয়ের বীজ রোপিত হয়। যার ফলে গত বিধানসভা ভোটের স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনে ব্যাপক ভাটা পড়ে। দল অনায়াসে যেখানে ১২০-১৩০টি আসনের গন্ডি টপকে যেতে পারত, সেখানে মাত্র ৭৭টি আসনেই বিজেপির বিজয়রথ থেমে যায়।
আর এই সব কিছুর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করা হয় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয় বর্গীয়কে। কারণ তিনিই ছিলেন দলের টিকিট বন্টনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক। তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্যের অধিকাংশ বিধানসভা কেন্দ্রে টাকার বিনিময়ে টিকিট বন্টনের অভিযোগ ওঠে। এমনকি টিকিট বন্টন নিয়ে এই দুর্নীতির অভিযোগ পৌঁছয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। একাধিক নেতার বিরুদ্ধে মহিলাদের সংশ্রবের অভিযোগ তোলেন দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায় ও অন্যান্য প্রাক্তনীরা। এবার মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট বৈতরণী পার করতে কৈলাশ এগিয়ে আসায় আড়াই বছরের সেই পুরনো বিতর্ক ফের উস্কে দিলেন বিজেপি-র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়।