নতুন সভাধিপতি স্বরূপনগরের ভূমিপুত্র, কে বেশি শক্তিশালী ,নারায়ণ নাকি বীণা?
সুভাষ পাল, সংবাদ কলকাতা: উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের নতুন সভাধিপতি হলেন স্বরূপনগরের ভূমিপুত্র নারায়ণ গোস্বামী। মঙ্গলবার নতুন জেলা সভাধিপতি হওয়ার পর নিলেন অঙ্গীকার। আগাম ঘোষণা করে দিলেন, রাজ্যের মধ্যে সেরা হয়ে উঠবে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। নতুন জেলা পরিষদ সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করবে। মঙ্গলবার জেলা পরিষদের সভাধিপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু, তাপস রায় ও খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ সহ অন্যান্যরা। জেলা পরিষদের ৬৬ জন সদস্যের উপস্থিতিতে সভাধিপতি হন নারায়ণবাবু। তাঁদের সামনেই এই অঙ্গীকারের কথা জানান অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী। এবার সহ-সভাধিপতি হলেন প্রাক্তন সভাধিপতি বীণা মণ্ডল। বীণা মণ্ডল স্বরূপনগরের ভুমিকন্যা ও বিধায়ক। এই দুই নেতৃত্বের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক বলে স্বরূপনগরের অনেকে দাবি করেন। তাঁর উপস্থিতিতে নারায়ণ গোস্বামী দলকে বার্তা দিয়েছেন, সবাইকে এক হয়েই কাজ করতে হবে। এভাবেই জেলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এদিন তিনি এই বার্তা দিলেও বীণাপন্থীরা তাঁকে কাজে কতটা সহযোগিতা করবেন, তা নিয়ে জেলার রাজনৈতিক মহলে রয়েছে একাধিক সংশয়। তবে তিনি সভাধিপতি হওয়ার পর এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে এবার তিনি যে স্বরূপনগরের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে নামবেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পাশাপাশি, জেলার বিভিন্ন ব্লকে দলের ভিতরে ও প্রশাসনিক পর্যায়ে তাঁর প্রভাব আরও বাড়তে চলেছে।
সূত্রের খবর, একসময় বীণা মণ্ডল মুখ্যমন্ত্রীর খুবই অনুগত হয়ে ওঠেন। জেলার মহিলা সভাধিপতি ও বিধায়ক হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ে। ফলে জেলাজুড়ে গ্রামীণ স্তরে দলে ও প্রশাসনে তাঁর প্রভাব বাড়ে। বিশেষভাবে স্বরূপনগর ব্লক ও বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে। কারণ বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে তিনিই একমাত্র তৃণমূল বিধায়ক। বাকি সব বিজেপি-র দখলে চলে গেছে। একমাত্র তিনিই স্বরূপনগরে তৃণমূলের দুর্গ আগলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অনুগত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা এখানে শক্তিশালী। বরং নারায়ণপন্থী পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন কোণঠাসা। এবার নির্বাচনে অনেকে টিকিট পর্যন্ত পায়নি বলে সূত্রের খবর। আগে যাঁরা জয়লাভ করেছিলেন, তাঁদের অনেকে পঞ্চায়েতের কাজ পাননি। আবার যেসব পঞ্চায়েতে নারায়ণপন্থীরা শক্তিশালী, সেখানে বীণাপন্থীরা কোণঠাসা বলে সূত্রের খবর।
প্রসঙ্গত বুধবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি, সহ সভাধিপতির নাম ঘোষণা হয়। এরপর জেলা পরিষদে একটি সংবর্ধনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, পার্থ ভৌমিক, সুজিত বসু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, রথীন ঘোষ সহ অন্যান্যরা। এর আগে নারায়ণ গোস্বামী জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন। এদিন জেলা পরিষদের সামনে অনুষ্ঠানে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বিজয়ের আনন্দে মঞ্চে উঠে গান গাইতে দেখা যায় তাঁকে।
উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে কংগ্রেস বলতে একই পরিবারের দুটি মুখ স্বরূপনগরবাসীর মনে ভেসে উঠত। নারায়ণ গোস্বামী ও তাঁর ক্ষুর্তুত দাদা প্রবীর গোস্বামী। বাম জমানার প্রবল প্রতাপের মধ্যেও দুজনেই ছিলেন অকুতোভয়। তবে দুজনের মধ্যে নীতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শের কিছু পার্থক্য ছিল। নারায়ণ গোস্বামী ছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতাপন্থী আর প্রবীর গোস্বামী ছিলেন দলের প্রদেশ সভাপতি সৌমেনপন্থী। সেজন্য দুজনের মধ্যে একটা মতবিরোধ থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস থেকে ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন হওয়ার পর দুজনের অভিমুখ সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হলেও সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি।
২০০১ সালে স্বরূপনগরে জোটের প্রার্থী হিসেবে তৃণমূলের স্বরাজ মিশ্র টিকিট পান। এতে প্রবীর গোস্বামী ক্ষেপে ওঠেন। তিনি জোটের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফলে প্রবীর গোস্বামী যে ৫-৬ হাজার ভোট কাটেন, সেই মার্জিন ভোটে বামফ্রন্ট প্রার্থী মোস্তফা বিন কাশেম অনায়াসে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যেই গোস্বামী পরিবারের বাড়ি সংলগ্ন হঠাৎগঞ্জ বাজারে একদিন সন্ধ্যাবেলায় একটি মারুতি গাড়ি থামে। যেখানে প্রবীর গোস্বামী দলীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। সেখানে গাড়ি থেকে একদল দুষ্কৃতী নেমে প্রবীরবাবুর দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে এবং এলোপাথাড়ি বোমা ছুঁড়ে রাস্তা ফাঁকা করে দুষ্কৃতীরা গা ঢাকা দেয়। হাসপাতালে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
এরপর নারায়ণ গোস্বামী ও রমেন সর্দাররা তৃণমূলকে এগিয়ে নিয়ে যান। মাঝপথে বীণা মণ্ডল বিধায়ক হওয়ার পর সেই সমীকরণের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। স্বরূপনগরে অনেক পঞ্চায়েতে নারায়ণপন্থীরা শক্তিহীন হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, এবার বোধহয় দলে পালাবদল হতে চলেছে।