অয়ন বিশ্বাস: “ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভেতর ভাতের প্রতিমা”—আমাদের সে প্রতিমা দর্শনের সুযোগ হয় ফি বছর। এই আশ্চর্য কাব্য পংক্তিটির জন্মদাতা কবি মানুষটি নিজে সে প্রতিমাকে দেখতে পান। তবে একা তাকে দেখে সুখ হয় না তাঁর, চারদিক থেকে সমমনস্ক, সংস্কৃতিপ্রিয় বন্ধুদের তাই ডেকে ডুকে আনেন তিনি তাঁর নিজের গ্রামের আমবাগানের ছায়ায়। হাঁসচরা পুকুরের পাড়ে ঘাসের গালিচায় বসান তাঁদের মুখের কথা শুনতে, স্বরচিত কাব্যপাঠ শুনতে।
তিনি শ্রী শুভঙ্কর দাস। আমাদের প্রিয় রাম-দা। পেশায় প্রাক্তন সরকারি গ্রন্থাগারিক। কবিতা, ছবি, সাহিত্য পত্রিকা ‘সুজনেষু’ সম্পাদনা আর রকমারি গাছেদের লালন করাই নেশা তাঁর। অবশ্য তারা সবাই মিলে সেই কবে থেকে অবসরপ্রাপ্ত এ মানুষটিকে লালন পালন করে চলেছেন–একথা বললে অত্যুক্তি হয় না এতটুকু!
ছবির মতো ছিমছাম, সুন্দর আপন ভদ্রাসনটির নাম তিনি রেখেছেন তাঁর আত্মজার নামে : বৃষ্টি। বাহারি গাছগাছালি, সত্যিকারের পাখির বাসা, বুনো গাছপালা, ছবি আর নানা রঙের, হরেক স্বাদের বইতে সাজানো সেই বাড়িটি আড়বালিয়া গ্রামে। এই গ্রাম তথা বাদুড়িয়ার ভূমিপুত্র, প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব, ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ শ্রী বিজন ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৭৮)-এর নামাঙ্কিত একটি স্মৃতি সম্মান পুরস্কার সেই ২০০৯ থেকে প্রতি বছর তিনি তুলে দিচ্ছেন শিল্প ও সাহিত্য জগতের প্রথিতযশা নক্ষত্রদের হাতে। ইতিমধ্যে এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন জহর সেন মজুমদার, সুমন ধারা শর্মা, অগ্নি রায়, বিমল দেব, গোলাম রসুল, জলধি হালদার, সোহারাব হোসেন বা বিনোদ ঘোষালের মতো উজ্জ্বল তারারা।
এবছর এই পুরস্কার পেলেন প্রখ্যাত নট, নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক শ্রী মেঘনাদ ভট্টাচার্য। অধুনা মহানগরের বাসিন্দা হলেও ঘটনাচক্রে তিনিও এই আড়বালিয়ারই ভূমিপুত্র। অগ্নিপুরুষ অরবিন্দ ঘোষের সহচর বিপ্লবী অবিনাশ ভট্টাচার্যের বংশধর। ৭১ বছর পেরিয়ে এখনও তরতাজা যুবক! গত ৫৫ বছর ধরে দেশ বিদেশের নানা মঞ্চে, ৫০টিরও বেশি টিভি সিরিয়াল ও সিনেমায় যিনি তাঁর অসামান্য নাট্যপ্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্রের মতো দিকপালদের সাথে শুধু যে অভিনয় করেছেন, তা নয়। তাঁদের নামাঙ্কিত পুরস্কারগুলিও অর্জন করেছেন। বিজন থিয়েটার ও সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য বেশ কয়েকবার হাতের মুঠোয় ধরেছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা ও সেরা পরিচালকের পুরস্কার।
১৯ মার্চ– গত রবিবারের ডাহুক-ডাকা বৃষ্টিস্নাত দুপুরে ‘সুজনেষু’-র পক্ষ থেকে এমন একজন কৃতী ভূমিপুত্রের হাতে তুলে দেওয়া হল ‘বিজন ভট্টাচার্য স্মৃতি সম্মান পুরস্কার ২০২৩’। স্থান মাহাত্ম্য বলেও তো একখানা কথা আছে। সেটিও উল্লেখ করা দরকার। আন্তরিক এই সংবর্ধনা ও সাহিত্যের আড্ডা বসেছিল আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম পল্টুদের বাড়ি। বাংলার টেলিভিশন আর রুপোলি পর্দার জগৎ যে লোকপ্রিয় চরিত্রাভিনেতাকে পোশাকি ‘বিশ্বনাথ বসু’ নামে একডাকে চেনে।
ওদের আড়বালিয়ার পুরাতন বসুবাটির সাদা দেওয়াল আর কারুকৃতিময় খিলানওয়ালা দুর্গাদালানের খাড়াই লাল সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখা গেল, দালানের ডানদিকে কাঠবাঁধাই নেভিনীল কাপড়ের উপর দেবদারুর কয়েকটি নির্জন পাতা বুনে রচনা করা হয়েছে অনাড়ম্বর মঞ্চের প্রেক্ষাপট। এতে অবশ্য অভিনবত্ব কিছু নেই, বরং বলা যায় এমন মঞ্চসজ্জাটাই ‘সুজনেষু’-র যে কোনও অনুষ্ঠানের চেনা ‘সিগনেচার টিউন’। অন্তত আমরা, যারা এই বচ্ছরকার আড্ডার আসরের মৌতাত উপভোগ করে আসছি অনেক বছর আগে থেকে– তাদের কাছে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বৃক্ষপ্রাণ পরিবেশকর্মী তুষার গুহ এদিনের অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। পল্টুর মা, শ্রদ্ধেয়া ছায়া কাকিমা তাঁদের পারিবারিক ঠাকুরদালানের এই মঞ্চে মঙ্গলদীপ জ্বেলে সাহিত্যের আড্ডার শুভ সূচনা করেন। বসুদের সাবেক বসতবাটির ছোটোখাটো মাঠের মতো উঠোনটা ঘিরে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বাহারি জিঞ্জিরা গাছেদের সারি, সেখানেই চিরাচরিত রীতি মেনে মেঘনাদবাবুর হাতে মাটির আসনে বসল আরও একটি শিশু জিঞ্জিরা। সেই বৃক্ষরোপণের কাজে রাম-দা সাহায্য করলেন তাঁকে। প্রতি বছর যিনিই এই পুরস্কার গ্রহণ করেন, তাঁর হাতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে এই আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণ পর্ব।
যে মাটিতে বৃক্ষরোপণ হল, নাছোড় বৃষ্টিকে তো নেমে আসতেই হবে তার বুকে। এলোও। এদিন নবরোপিত বৃক্ষমূলে জলসিঞ্চনের প্রায় পরপরই তাই বুঝি মৃদু মেঘগর্জনের সাথে শুরু হল ধারাপাত। ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগল ধারাবর্ষণ। চৈতালি দুপুরে আকাশ ফুঁড়ে যেন নেমে এলো অঝোর শাওন! আলো কমে এলো, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ঝোড়ো বাতাসের খামখেয়ালিপনা! তবে শেষমেশ সাহিত্যবাসর জমে ওঠার পথে সে কোনও বাধা হয়ে উঠতে পারেনি অবশ্য।
একটি চারাগাছ, বসিরহাটের ঐতিহ্যমণ্ডিত কুটীর শিল্প লালসাদা গামছার উত্তরীয়, সুদৃশ্য সচিত্র মানপত্র, পাঁচটি ফলের ডালি, ফুলের স্তবক, মিষ্টান্ন, আসল পাখির বাসা, ডায়েরি আর কলমের নৈবেদ্যে খ্যাতনামা নাট্য ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করে আমরাই কৃতার্থ হলাম। ভাই আশিস হালদার ও বন্ধুবর অধ্যাপক অরুণ কুমার পাল সহ অনেকে তাঁদের সম্পাদিত বা প্রণীত বই বা পত্রিকা তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আমিও ‘জনান্তিক’-এর গত শারদ অর্ঘ্য তাঁকে উপহার দিলাম। প্রাণের সংবর্ধনা ও সেই সমস্ত প্রাপ্তির উত্তরে মনোজ্ঞ কথা আর স্মৃতিচারণায় তারপর তিনি সমৃদ্ধ আর মোহিত করলেন আমাদের। সমবেত সাহিত্যপিপাসু, নাট্যামোদী রসিকজনের কাছে সে যে বড়ো মহার্ঘ প্রাপ্তিযোগ!
ঘণ্টা দুয়েক পর লাঞ্চ ব্রেক। সাহিত্যসভার মাঝপথেই সম্পাদক ডাকলেন ভাতের থালায় বসার জন্য। তখন একটু যেন দাপট কমেছে বর্ষার। দুর্গাদালান থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিমাথায় নেমে পৌঁছলাম পল্টুদের বাড়ির একতলার বারান্দায়। লাল্টুদার মায়াবি হাতের রান্না—ভাত, ডাল, আলুভাজা, ইঁচড়-চিংড়ি, কাতলা কালিয়া, আম-চাটনি, পাঁপড় আর মোহিনী রসগোল্লার বাহারে রবিবারের অলস দুপুরের এক্কেবারে নির্ভেজাল বাঙালি মেনু! তার উপর উপর্ঝরণ বৃষ্টির মধ্যে ফ্যানঝরানো, ধোঁয়া ওঠা, গরমাগরম ভাতের গন্ধে যেন নতুন করে, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলাম ‘সুজনেষু’ পত্রিকার সেই বহুশ্রুত “ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভেতর ভাতের প্রতিমা”—ট্যাগলাইনের মর্মার্থটিকে। কবি রাম-দা সেটাকে যা-ই ভেবে লিখে থাকুন না কেন!
তাঁর অনুরোধে সাহিত্য বাসরের উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসাবে গেয়েছিলাম প্রাণের মানুষ লালন সাঁইয়ের একটি মরমি সৃষ্টি। শুধু তাই নয়, সম্পাদকের নির্দেশে আজকের অনুষ্ঠানের সংবর্ধনা পর্বটি ছাড়া প্রায় সমস্তটাই সঞ্চালনার ভারও নিতে হলো এই অর্বাচীনকে। নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীতের কথা অনেকদিন মনে থাকবে। মনে থাকবে শ্রীময়ী ভট্টাচার্যের মানপত্র পাঠ ও “পুরানো সেই দিনের কথা…” রবীন্দ্রগানের কথা। মনে রাখব মিতা সেন মজুমদারের গাওয়া “আমি শুনেছি সেদিন তুমি…”—-আড্ডার সমাপ্তিসূচক সুরেলা পরিবেশনাটিও।
মাঝে মাঝে লোডশেডিং মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমরা কানাডার অটোয়াতে নয়, বাদুড়িয়ার আড়বালিয়াতেই আছি। যাই হোক, কিছুক্ষণের জন্য সাহিত্যসেবীদের কণ্ঠকে অ-মাইক হয়ে ওঠার সুযোগ তো করে দিচ্ছিল সে!
সম্পাদক রাম-দা ‘সুজনেষু’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের আন্তরিক আমন্ত্রণ পত্রে এদিনের আড্ডার ঠেকে পৌঁছানোর যে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন, সমগ্র অনুষ্ঠানটির নিবিড় অনুধ্যান করে দেখা গেল, কখন যেন আমরা আড্ডার খেয়ালি খেয়ায় ভাসতে ভাসতে উপনীত হয়েছি সেই পারঘাটায়। যেখানে পাড়ে ওঠার মুখে, অদৃশ্য সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘সুজনেষু’-র সম্পাদক-কবির কলমপ্রসূত তাঁর সেই বসতবাড়ির ঠিকানা : “হৃদয় বরাবর হেঁটে এলেই আমার বাড়ি।”
previous post