April 20, 2025
দেশ রাজ্য

প্রতিদিন ব্রহ্ম মুহূর্তে কেন ঘুম থেকে উঠবেন?

সুভাষ পাল, সংবাদ কলকাতা: এখন সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি আর বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থায় চাকরির ফলে আমরা প্রায়শই খুবই রাত্রি করে ঘুমায়। যার ফলে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে যায়। অনেকে এখন সকাল বলতে সকাল ৮টা বুঝে থাকেন। অনেকে আবার সকাল ১০টার সময়ও ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। কারণ, কোনও কর্পোরেট সংস্থা বা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে নাইট ডিউটি করার ফলে তাঁরা ঘুমাতে যান ভোরবেলায়। যা শরীর ও মনের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু একটা সময় ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বয়স্ক বা গুরুজনেরা ভোরবেলা বা ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য খুবই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। এই তো! গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক, কিম্বা এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও গ্রাম এবং শহরেও এই রেওয়াজ ছিল। কিন্তু, যখন থেকে স্মার্ট ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হল, তখন থেকেই সব ওলোট পালট হতে শুরু করল। অধিক রাত্রি জাগরণ, আর ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা, এখন বর্তমান প্রজন্মের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ ব্রহ্ম মুহূর্তে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ব্রহ্ম মুহূর্ত কী?
কিন্তু এই ব্রহ্ম মুহূর্ত বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? ‘ব্রহ্ম’ কথাটির অর্থ ‘ব্রহ্মা’ তথা বিশ্ব। আর ‘মুহূর্ত’ কথার অর্থ সময়। মোদ্দা কথা, “ব্রহ্ম মুহূর্ত” কথার অর্থ এই বিশ্বের সময়। হিন্দু সংস্কৃতি অনুসারে এই সময়কে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সময় হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ভারতীয় সংস্কৃতি অনুসারে ২৪ ঘন্টাকে মোট ৩০টি মুহূর্তে ভাগ করা হয়েছে। এক একটি মুহূর্তকে মোটামুটি ৪৮ মিনিট করে ধরা হয়ে থাকে। এভাবে দিনে ১৫টি ও রাতে আরও ১৫টি মুহূর্ত ধরা হয়েছে। আর রাতের ১৪তম মুহূর্তকে ব্রহ্ম মুহূর্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত সূর্য উদয়ের আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত থাকে। এই দুটি মুহূর্তের প্রথম মুহূর্তকে ব্রহ্ম মুহূর্ত বলা হয়। ব্রহ্ম মুহূর্তের সময়কাল ৪৮ মিনিট। অর্থাৎ প্রতিদিন সূর্য উদয়ের ঠিক ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট আগে এই ব্রহ্ম মুহূর্ত শুরু হয়ে যায়। এবং সূর্য উদয়ের ৪৮ মিনিট আগে সেটি সমাপ্ত হয়ে যায়। তবে বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল অনুসারে এই ব্রহ্ম মূহর্ত এক এক জায়গায় এক এক রকম হতে পারে। আবার বিভিন্ন ঋতু অনুসারেও এক এক দিনে ব্রহ্ম মুহূর্ত এক এক সময়ে হতে পারে।

ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠার ফলে আমরা কী কী উপকার পেতে পারি?
ব্রহ্ম মুহূর্তের সঙ্গে প্রকৃতির একটি গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সময়ে গোটা প্রকৃতি জেগে ওঠে। এই সময়ে পশুপাখির কলরব শোনা যায়। সরোবরে পদ্ম ফুটে ওঠে। এভাবে প্রকৃতিই যেন মানুষের কাছে বার্তা পাঠায়, ঘুম থেকে উঠে দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য। এই ব্রহ্ম মুহূর্তের সময়ে করা কাজ যেমন- ধ্যান, যোগা, মন্ত্র জপ, মেডিটেশন সহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক কাজকর্ম করার সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই সময়ে সেগুলি বেশি কার্যকরী হয়ে থাকে। এরফলে আমাদের মস্তিষ্কের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই সময়ে ঘুম থেকে উঠলে মনে এক অনাবিল আনন্দের উর্দ্রেক হয়। এভাবে কয়েকদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। ব্রহ্ম মুহূর্ত শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সহ বিভিন্ন দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র অনুসারে ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠলে চিন্তা, অনিদ্রা, হতাশা সহ নানান মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বেদে এই ব্রহ্ম মুহূর্তকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠার ফলে বিদ্যা, বুদ্ধি ও বল লাভ করা যায়। যেকোনও কাজই ব্রহ্ম মুহূর্তে শুরু করা খুবই ফলদায়ক হয়। এই ব্রহ্ম মুহূর্তের অমৃততুল্য বাতাস স্বাস্থ্য এবং বুদ্ধি দুটোই বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। হিন্দু শাস্ত্রে ব্রহ্ম মুহূর্তের মাহাত্ম্যের কথা বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে এই ব্রহ্ম মুহূর্তকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে প্রাকৃতিক কাজ সেরে, হাত-মুখ ধুয়ে আধঘণ্টা প্রাণায়ম করলে মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে গৃহস্থের অন্দরে পজিটিভ শক্তি বেড়ে যায়। যা ব্যক্তিজীবনের নানা বাধা সরিয়ে অগ্রসর হওয়া যায়।

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ব্রহ্ম মুহূর্ত
হিন্দু শাস্ত্রে কথিত আছে, এই সময়ে ধ্যান, পূজা অর্চনা করে সূর্যকে অতিথি হিসেবে গণ্য করে তাঁকে সাদরে আহবান জানানোর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এভাবে আর একটি পবিত্র ও নতুন দিন শুরু করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। শাস্ত্রে কথিত আছে, যাঁরা সূর্য উদয়ের পরে ঘুম থেকে ওঠেন, তাঁরা সূর্য দেবের অভিশাপে অভিশপ্ত হন। এবং যাঁরা আগে ওঠেন, তাঁরা সূর্যের আশীর্বাদ লাভ করেন।

ব্রহ্ম মুহূর্তের ধার্মিক মাহাত্ম্য
এই ব্রহ্ম মুহূর্তের ধার্মিক মাহাত্ম্যও আছে। মহর্ষি বাল্মীকির রচিত রামায়ণে লঙ্কায় হনুমানজি এই ব্রহ্ম মুহূর্তেই প্রবেশ করেছিলেন। এবং সীতা মাতার মন্ত্র জপের শব্দ অনুসরণ করে হনুমানজি সীতা মাতার কাছে পৌঁছেছিলেন। ব্রহ্ম মুহূর্তে যাওয়ার ফলে হনুমানজির কাজ খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্ম মুহূর্তে ওঠার ফলে প্রত্যেকটি ব্যক্তির সফলতা প্রাপ্ত করার ক্ষমতা অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। মোটামুটি ভোর তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ব্রহ্ম মুহূর্তের সময়ে ধ্যান ও মন্ত্র জপের জন্য আদর্শ সময় হিসেবে মানা হয়। কারণ, এই সময়ে আমাদের জাগরুকতা এবং একাত্মতা আমাদের দেহের কেন্দ্রস্থলে থাকে। বিভিন্ন যোগগুরু বলে থাকেন, ধ্যান করার সব থেকে উপযুক্ত সময় হচ্ছে এই ব্রহ্ম মুহূর্ত। কেননা, এই সময়ে আমাদের মনের প্রকৃতি খুবই শান্ত থাকে। এবং এটা এমন একটি সময়, যেটা আমাদের মনের সঙ্গে আমাদের অতীতের সম্পর্ক প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময়ে যেকোনও কাজের ওপর মনোনিবেশ করা খুবই সহজ হয়ে যায়। এই মনোনিবেশ বা একাগ্রতা যে কোনও কাজে সফল হওয়ার প্রথম চাবিকাঠি। আমরা আমাদের কাজে যত একাগ্রতা আনব, সেই কাজ ততই সফল হবে। যখন গুরু দ্রোণাচার্যকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সমস্ত কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে কেন অর্জুনই সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়ে উঠল? তখন গুরু দ্রোণাচার্য বলেছিলেন, অর্জুনের একাগ্রতার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হতে পেরেছে। কারণ, অর্জুন প্রত্যেকটি কাজ খুবই একাগ্রতার সঙ্গে করে থাকে। সে রাত্রিবেলা ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করত। সে তাঁর নিদ্রাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ব্রহ্ম মুহূর্ত সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের ধারণা
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক যোগা ও বিজ্ঞান সংস্থা জানিয়েছে, এই ব্রহ্ম মুহূর্তে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা সব থেকে বেশি থাকে। এই অক্সিজেন আমাদের দেহের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে মিশে অক্সি হিমোগ্লোবিন বানায়। যা আমাদের শরীরের পক্ষে খুবই উপকারী। এর বিভিন্ন উপকারী দিক আছে। প্রথমত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। দ্বিতীয়ত শরীরের উর্জা স্তর বৃদ্ধি করে। তৃতীয়ত, রক্তে বীজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে। চতুর্থত শরীরের বিভিন্ন ব্যথা, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পঞ্চমত শরীরের খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনের উপযোগিতা আরও বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, এই ব্রহ্ম মুহূর্তে বাতাসে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। ফলে এই সময়ে ঘুম থেকে উঠলে আমাদের শরীরে মেলাটনিন হরমোন ক্ষরিত হয়। যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে থাকে। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। মানবদেহের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগ থেকেও মুক্তি লাভ হয়। এছাড়াও পাচনতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাড়তি মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ মন ও শরীর দুটোই সুস্থ হয়ে ওঠে। ফলে ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং আসুন, আজ থেকেই সঙ্কল্প করি, যাতে এবার থেকে একটিও ব্রহ্ম মুহূর্তে ওঠার সুফল থেকে বঞ্চিত না হই।

Related posts

Leave a Comment